পদোন্নতিতে ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক: কেন্দ্রীয় ব্যাংক-ব্যাংককর্মীরা মুখোমুখি

30

কাজিরবাজার ডেস্ক

ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বা সমমানের পদ থেকে পদোন্নতি পেতে ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকারদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

কিন্তু ব্যাংকাররা বলছে, নির্দেশনা অপ্রয়োজনীয়, নিবর্তনমূলক ও অবিবেচনা প্রসূত।

ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সমমানে পদোন্নতির জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করে গত৮ ফেব্রুয়ারি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কর্মকর্তা ও সমমানের পদ থেকে মহাব্যবস্থাপক ও সমমানের পদ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত মোট নম্বরের মধ্যে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পাসের জন্য নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও নির্দেশ দেওয়া হয় সার্কুলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে জোর দেন। তিনি বলেন, ডিপ্লোমায় সনদপ্রাপ্ত ব্যাংকারদের অর্জিত জ্ঞান ও মননশীলতা আর্থিক খাতের উন্নতি ত্বরান্বিত করবে।

অন্যদিকে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করাকে নিপীড়ন বলে মনে করছে ব্যাংকার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ। সংগঠনটি বলছে, ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক অপ্রয়োজনীয়। একই সঙ্গে কারিকুলাম ও পরীক্ষা ত্রুটিমূলক। অনেকটা পোশাকি ও তত্ত্বমূলক। যা বাস্তব ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করা হলে কাজের মধ্য দিয়ে অর্জিত দক্ষতা ও দক্ষ ব্যাংকারদের অবমূল্যায়ন করা হবে। ব্যাংকের চাকরি শুরুর পর ফাউন্ডেশন কোর্স ও নতুন নতুন কাজের মধ্য দিয়ে যে কর্মকর্তা দক্ষ হলেন সেটিকে অবমূল্যায়ন করা হবে। ফলে ব্যাংকাররা কাজে মনোযোগ হারাবে।

এ বিষয়ে ব্যাংকার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী মো. শফিকুর রহমান বলেন, প্রমোশনের ক্ষেত্রে আগে ডিপ্লোমার জন্য নম্বর বাধ্যতামূলক ছিল না। এখন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন সার্কুলার দিয়ে এটা বাধ্যতামূলক করা হলো। প্রত্যেকের ডিপ্লোমা থাকা লাগবে, তা না হলে প্রমোশনই হবে না; উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যন্ত কোনো প্রমোশন হবে না। এখানে প্রশ্ন হলো, প্রত্যেকের বেসিক ট্রেনিং বা ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হয়। বিআইবিএম’এ একটি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব কোর্স রয়েছে। এরপরও যদি মনে করে একজন কর্মকর্তার ট্রেনিং প্রয়োজন তখন তাকে ব্যাংকের নিজস্ব একাডেমি ও বিআইবিএম’এ নির্দিষ্ট কোর্স করানো হয়। এ সব বিবেচনায় আমরা বলছি ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক অযৌক্তিক। যদি ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করতেই হয় তা হলে সেটা চাকরিতে নিয়োগের সময় করা হোক।

তিনি বলেন, আগে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার নম্বর নিয়ে কথা হয়েছিল। তখন ডিপ্লোমার জন্য অতিরিক্ত নম্বর যুক্ত করা হয়। আমরা সেটা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি অযৌক্তিক। চাকরিতে যোগদানের পর ডিপ্লোমা ছাড়া প্রমোশন হবে না, এটা হতে পারে না। যদি বাধ্যতামূলক করতেই হয় তাহলে চাকরি ঢোকার সময় বলা হোক। চাকরিতে যোগদানের পর ডিপ্লোমা ছাড়া প্রমোশন হবে না, প্রমোশন নিতে হলে ডিপ্লোমা করতেই হবে, ব্যাংকাররা এ সার্কুলারের বিপক্ষে।

কাজী মো. শফিকুর রহমান আরও বলেন, সব ব্যাংক কর্মীর অন্যান্য ডিগ্রি আছে, ট্রেনিং আছে, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে, ব্যবহারিক শিক্ষা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তাদের দায়িত্ব পালন করিয়ে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। এ জন্য ডিপ্লোমায় নির্ধারিত নম্বর এডিশনাল থাকে। আমরা সেটা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে- এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে অনীহা ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আছে। তারা বলছেন, ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রমটাই ত্রুটিতে ভরা। প্রথমত এটি একটি তাত্ত্বিক বিষয়। প্রায়োগিক ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে এর খুব সম্পর্ক নেই। ব্যাংকিং কার্যক্রমের মতো কঠিন পেশা ও পারিবারিক দায়িত্ব পালন করে এ কোর্স করতে হয়। আবার একদিনে ছয় ঘণ্টা পরীক্ষা দিতে হয়। দেখা গেল, পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে ভালো পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হচ্ছে অনেকেই। আবার যেন-তেন পরীক্ষা দিয়েও কেউ ভালো করছে। ঠুনকো, অব্যবস্থাপনায় ভরা ডিপ্লোমা ফলাফল কখনো বাধ্যতামূলক হতে পারে না।

এদিকে, যারা ডিপ্লোমা পাস করেছে তাদের বক্তব্য ভিন্ন। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (আইবিবি) মহাসচিব লাইলা বিলকিস আরা বলেন, ব্যাংকিং ডিপ্লোমার দুটি স্তর। প্রথমটিতে ব্যাংকিং বিষয়ে প্রাথমিক ও মৌলিক জ্ঞান লাভ। দ্বিতীয় স্তরে ব্যাংকিং বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান লাভ করা। যারা ডিপ্লোমা পাস করেছে তারা এ দুয়ের সমন্বয়ে চাকরি করছেন।

ব্যাংকার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ক কাজী সাহেদ রহমান এ ব্যাপারে বলেন, ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রমটাই অনেকটা গতানুগতিক। ব্যাংকিং খাতের ডিপ্লোমার বাস্তবে প্রয়োগ নেই। এখনকার লেখাপড়ার যে ধরণ, যারা বিবিএ-এমবিএ করে আসছেন- তারা তো পুরো ব্যাংকিং কভার করেই আসছেন। তারপরও তারা ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পর স্থায়ী হচ্ছেন না। তিন মাসের একটি ফাউন্ডেশন কোর্স করে তাদের পাস করতে হচ্ছে!

তিনি আরও বলেন, বিবিএ-এমবিএ কোর্সে ব্যাংকিং সম্পর্কিত সব ধরণের লেখাপড়া হচ্ছে, যা ব্যাংকিং ডিপ্লোমার চেয়ে ভালো। তারপরও ডিপ্লোমা না হলে একজন কর্মকর্তা প্রমোশন পাবেন না, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ‘ব্যাংক কর্মকর্তা পদোন্নতি নীতিমালায় ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাস বাধ্যতামূলক চায় না’ মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বরাবর একটি চিঠি পাঠায় ব্যাংকার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ।

ব্যাংকার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি কাজী মো. শফিকুর রহমানের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০২০ সালের অক্টোবরে বিআরপিডির নির্দেশনায় ব্যাংক কর্মকর্তা পদোন্নতি নীতিমালায় গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। যথাযথ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার পর বিভিন্ন ব্যাংকে জুনিয়র বা সিনিয়র কর্মকর্তা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এরপর তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে অরিয়েন্টেশন দেওয়ার পর মৌলিক প্রশিক্ষণ ও বিআইবিএম এ এক মাস ধরে ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রশিক্ষণের পর কর্মকর্তাদের ব্যাংকের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে কাজ শেখার সুযোগ দেওয়া হয়।

অর্থাৎ প্রত্যেক কর্মকর্তাই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ শেখার সুযোগ পায়। এরপরও ব্যবস্থাপনা ইউনিট প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টে দক্ষ করে তুলতে নিজস্ব প্রশিক্ষণ একাডেমি বা প্রয়োজনে বিআইবিএম এ নির্দিষ্ট কোর্সে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়।

ব্যাংকের নিজস্ব প্রশিক্ষণ একাডেমি ও বিআইবিএম এ প্রতিটি প্রশিক্ষণ একাডেমিরই যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক ব্যাংকই নিজেদের কর্মকর্তাদের দক্ষ করে তুলতে সচেষ্ট থাকে। প্রতিটি পদোন্নতিও নির্দিষ্ট নির্ণায়ক ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে কর্ম দক্ষতা বিবেচনা করে বিভাগীয় প্রধান বা অন্যান্য উচ্চ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সর্বোপরি বড়ো বা গুরুত্বপূর্ণ শাখায় চাকরির পরিধি ও দক্ষতা বিবেচনায় তাদের নিয়োগ হয়।

বিষয়গুলো বিবেচনা করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহা বাড়াতে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাস বাধ্যতামূলক না করতে বিআরপিডির সার্কুলার (১৩/১০/২০২০) বহাল রাখতে ও বিআরপিডি সার্কুলার (০৮/০২/২০২৩) রহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।