সৈয়দ সুজাত আলী :
সৈয়দ ওসমান আলী সারেং ছিলেন সেই সময়ের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। একজন বিশিষ্ট জাহাজী শ্রমিক নেতা ও সাংবাদিক অবিভক্ত ভারতের ইন্ডিয়ান সীম্যানস ইউনিয়ন, বেঙ্গল মেরিনার্স ইউনিয়ন এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান ওভারসীজ সিমেন্স এসোসিয়শনের নেতৃত্বের সাথে ছিলেন ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত। কলকাতার জাহাজী শ্রমিক আন্দোলনের মহান নেতা আফতাব আলীর তিনি ছিলেন একেবারে দক্ষিণ হস্ত। সারেংদের মধ্যে তিনি ছিলেন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান ওভারসীজ সীম্যানস এসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশের জাহজী শ্রমিক ও নাবিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন এব বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সৈয়দ ওসমান আলী সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর গ্রামে ১৯০২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম সৈয়দ আব্দুল লতিফ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯২০ সালের আগস্ট মাসে তিনি সী সার্ভিসে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালের ২রা মার্চ পর্যন্ত সমুদ্রগামী জাহাজে কর্মরত ছিলেন। সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের অধিককাল সী সার্ভিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বিভিন্ন জাহাজে সারেং এবং ই.আর. সারেং হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সুনামের সাথে।
সৈয়দ ওসমান আলী ইন্ডিয়ান সীম্যানস ইউনিয়ন, বেঙ্গল মেরিনার্স ইউনিয়ন এবং পরবর্তিতে পাকিস্তান ওভারসীজ সীম্যানস এসোসিয়েশনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইন্ডিয়ান সীম্যানস ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৯১৮ সালের ৮ই মার্চ রোজ শুক্রবার। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সীম্যানস ইউনিয়ন এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন সৈয়দ ওসমান আলী সে সময় ইন্ডিয়ান সীম্যানস সভাপতি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রমিক নেতা সিলেটের কৃতিসন্তান মরহুম আফতাব আলী। জাহাজে চাকরির সুবাদে সৈয়দ ওসমান আলী এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের বহু দেশ সফর করেছেন। অন্যান্য জাহাজীদের মতো তিনিও ইচ্ছে করলে ইংল্যান্ড-আমেরিকায় স্থায়ভাবে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। ১৯৫৫ সালের ২ মার্চ নাবিক জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে কলকাতা সমুদ্রবন্দর থেকে দেশে ফিরে আসেন।
এসময় তার আন্তরিকতা নিষ্ঠার প্রসংশা করে বিভিন্ন জাহাজের ক্যাপ্টন ও ইঞ্জিনিয়ার প্রশংসাপত্র প্রদান করেন। যেমন-১১/১২/১৯৫৪ সালে সিটি অব ক্যানবেরা এর সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার রিচার্ড, ডি, ম্যাসি প্রদত্ত প্রংশসাপত্র। তিনি যে সব জাহাজে কাজ করেন এসব জাহাজের মধ্য ছিলো সিটি অব লক্ষৌ, সিটি অব সিঙ্গাপুর, সিটি অব কাইওয়র, সিটি অব চেষ্টার, সিটি অব সিডনী, সিটি অব বাগদাদ, সিটি অব কার্ডিফ, সিটি অব ওমান, সিটি অব অরল্যান্ড, সিটি অব ফ্লোরেন্স, সিটি অব ক্যান্টবারি, সিটি অব পোষ্টউথ, সিটি অব ডিন, সিটি অব ডারবী ও সিটি অব ক্যাপটাউন ইত্যাদি।
সৈয়দ ওসমান আলী ছিলেন সাংবাদিকতার প্রথিকৃৎ। ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাহাজী শ্রমিক নেতা আফতাব আলী সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘জাহাজী’ পত্রিকার মাধ্যমে তাহার সাংবাদিকতার হাতেকড়ি ১৯৫৭ সালে সিলেট থেকে বিখ্যাত সাংবাদিক মকবুল হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সিলেট পত্রিকা’র প্রকাশক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৪ সালে সাবেক জাহাজীদের এক সভা আফতাব আলী সাহেবের সভাপতিত্বে সিলেটে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গঠিত হয় পাকিস্তান সীম্যানস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন। আফতাব আলী প্রেসিডেন্ট এবং সৈয়দ ওসমানী আলী জেনারেল সেক্রেটারী। সিলেটীদের জাহাজীদের আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়। জাহাজীদের নথিপত্র প্রক্রিয়াজাত করার জন্য আফতাব আলী ও সৈয়দ ওসমান আলী মিলে সিলেটের প্রথম ট্রাভেল এজেন্সি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলস সিলেটের স্টেশন রোডের কমার্শিয়েল বিল্ডিংয়ে খোলেন। যা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চালু ছিলো। ঢাকার জনসন রোডে এর একটি শাখা ছিলো। তাদের কল্যানে বিপুল সংখ্যক মানুষ যুক্তরাজ্যে ফাঁড়ি জমিয়েছেন। ১৯৬০ সালে সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ও পরবর্তীতে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সৈয়দ ওসমান আলী।
১৯৭০ সালের দিকে সৈয়দ ওসমান আলী ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে সম্পূর্ণ অবসর জীবনে চলে যান। ১৯৮০ সালের ২৫ জানুয়ারী তিনি সিলেটে ইন্তেকাল করেন। মরহুম সৈয়দ ওসমান আলী ছিলেন সদালাপী, বন্ধুবৎসল এবং মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। জীবনভর মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। দেশে-বিদেশে তার আন্তরিক প্রয়াস ও মহতী কর্মকান্ডের কথা আজও মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। মরহুম সৈয়দ ওসমান আলীর একমাত্র পুত্র দৈনিক কাজিরবাজার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ সুজাত আলী।
সৈয়দ ওসমান আলী সারেং সম্বন্ধে বিশিষ্ট জনের মন্তব্য :
হোসেন তাওফিক চৌধুরী তাহার প্রবন্ধে লিখেন- আমার পিতা সাংবাদিক ও রাজনীতিবিধ মকবুল হোসনে চৌধুরী ১৯৫৭ সালে সিলেটে থেকে প্রকাশিত সপ্তাহিক ‘সিলেট পএিকা’এর সম্পাদক ছিলেন। পএিকার প্রকাশক ছিলেন সৈয়দপুরের সৈয়দ ওসমান আলী সারেং- ব্যারিষ্টার নৃরুল ইসলাম লিখেন- আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন জাহাজী শ্রমিক নেতা আফতাব আলী পরিচয় করিয়ে সৈয়দ ওসমান আলী সারেং এর সাথে যিনি সারেং হয়েও সারেং ও বাড়িওয়ালাদের অন্যায় আচরনের বিরুদ্ধ চারনকারী।
ক্যারলিন এডামস লিখিত ‘সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বইয়ের বাংলা অনুবাদকারী- ফয়জুল করিম লিখেছেন- ১৯৫৪ সালে আফতাব আলী সাবেক জাহাজীদের এক সভা ডাকলেন। সেখানে গঠিত হলো পাকিস্তান সিম্যান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন আফতাব আলী প্রেসিডেন্ট- সৈয়দ ওসমান আলী জেনারেল সেক্রেটারী। নাবিকদের নথিপত্র প্রক্রিয়াজাত করার জন্য সিলেটর প্রথম ট্রাভেলস এজেন্সি, সিলেট ইন্টারন্যাশন ট্রাভেলস এজেন্সি নামে একটি এজেন্সি খোলেন। অধ্যাপক আনছাফ হোসেন কোরেশি লিখেছেন- সৈয়দপুর সৈয়দিয়া শামছিয়া মাদ্রাসা থেকে অনেক কৃতি পুরুষ তৈরী হয়েছেন- তাদের মধ্যে সাংবাদিক সৈয়দ ওসমান আলী সারেং অন্যতম। তিনি সাপ্তাহিক ‘সিলেটে পত্রিকা’ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। তৌরিশ আলী সিলেটিদের লন্ডন যাওয়া নিয়ে বিখ্যাত গান লিখেছেন- উটলো রে লন্ডনের জ্বর বাড়ি – ঘর বিক্রি কর, তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট কর, দিন গইয়া যায়, আবদুল আজিম, সাইস্তা মিয়া, কলমদর লাগাইয়া সৈয়দ পুরের ওসামান আলী সারেংগো চাচায়-সকলে সল্লা করিয়া এপোলমেন্ট বাহির করিয়া মাত্র দেড়’শ টাকা দিলে পাসপোর্ট হইয়া যায়।