কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, আখেরাত ও দুনিয়ার শান্তি কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা জোবায়ের। আরবি ও উর্দু ভাষায় মোনাজাত করেন তিনি।
এ সময় তার সঙ্গে হাত তুলেন লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুণাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বিপদ-মুসিবত থেকে মানবজাতিকে হেফাজত করার জন্য দুই হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়।
এ সময় ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে তুরাগ তীর মুখরিত হয়ে উঠে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসল্লিরা।
রবিবার সকাল ১০টায় শুরু হয়ে ১০টা ২২ মিনিটে শেষ হয় আখেরি মোনাজাত।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে শনিবার রাত ১০টার পর থেকে আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত আব্দুল্লাহপুর-ভোগড়া বাইপাস ও কামারপাড়া-মীরেরবাজার এলাকায় পণ্যবাহী গাড়ি ডাইভারশন করা হয়েছে। এসব গাড়ি ইজতেমাস্থলে প্রবেশ করবে না। শুধু ইজতেমার মুসল্লিবাহী বাস ও গণপরিবহন চলাচল করবে।’
এদিকে রবিবার তুরাগ তীরে মোনাজাত শুরু হওয়ার পর লাখ লাখ মানুষ যে যেখানে ছিলেন, তারা দুহাত তুলে মোনাজাতে অংশ নেন। ইজতেমা মাঠ ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থানকারীরাও হাত তুলে মোনাজাতে অংশ নেন। ইজতেমাগামী সাধারণ মুসল্লি যারা তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে রওয়ানা হয়েছিলেন কিন্তু মোনাজাত শুরুর পর তারা সেখান থেকেই মোনাজাতে অংশ নেন। হাঁটতে হাঁটতেই দুহাত তুলে ইজতেমায় যেতে থাকেন।
মুসল্লিদের বাড়ি ফেরায় চরম দুর্ভোগ:
মোনাজাত শেষে লাখো মুসল্লি তাদের নিজস্ব গন্তব্যে যেতে যানবাহন সংকটে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। মোনাজাত শেষে লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে স্রোতের মতো এক সাথে ফিরতে শুরু করলে এক পর্যায়ে ময়দানের চতুর্দিকে ৬-৭ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা মানব বলয় সৃষ্টি হয়। এসব এলাকার সকল রাস্তায় এক পর্যায়ে মুসল্লিদের বাড়ি ফেরার স্রোতে পরিণত হয়। এসব এলাকার রাস্তায় মুসল্লির বাড়ি ফেরার স্রোতে কোনো যানবাহন চলাচল করতে না পাড়ায় মুসল্লিরা পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন।
ইজতেমা ও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ময়দানে ছুটে আসা দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের পদভারে আর আমিন, আমিন ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস ও গগনবিদারী আওয়াজ তুলেছিল টঙ্গীর এক সময়কার খরস্রোতা ঐতিহ্যবাহী কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের তীরবর্তী টঙ্গী শিল্প শহরকে। এতদঞ্চলের বৃহত্তম এ মুসলিম মহাসম্মেলনের প্রথম পর্বের ৩দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা শেষ হয়েছে।
শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এবারের বিশ্ব ইজতেমার আলমি শূরার তত্ত্বাবধানে (জুবায়েরপন্থি) প্রথম পর্ব সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ, বিশ্ব শান্তি, সমৃদ্ধি, হেদায়েত, মাগফিরাত এবং নাজাত কামনা করে পরম করুণাময় রাব্বুল আ’লামীনের দরবারে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান দু’হাত তুলে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুসূচনা করে পাপ মুক্তি কামনা করেন। এসময় ময়দানের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে কায়মনোবাক্যে উচ্চারিত হয়েছে মহান রাব্বুল আ’লামীনের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, মোনাজাতে মুসল্লিরা নিজের পাপমুক্তির পাশাপাশি মুসলিম ভাইদের শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে সকলেই আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। সকল ভেদাভেদ ভুলে আমীর-ফকির, ধনী-গরিব, মনিব-ভৃত্য একই কাতারে শামিল হয়ে গিয়েছিল শীর্ণকায় তুরাগ তীরকে ঘিরে।
আকাশপথে টহল: বিশ্ব ইজতেমায় যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে র্যাবের পক্ষ থেকে হেলিকপ্টারে পুরো টঙ্গী এলাকায় টহল দেওয়া হয়েছে।
বিনামূল্যে পানি বিতরণ: আগত মুসল্লিদের সুবিধার কথা চিন্তা করে বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে খাবার পানি ও সরবত বিতরণ করা হয়েছে।
মোনাজাতে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ:
শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে অবস্থিত পুলিশ ক্যাম্পে প্রথম পর্বের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে শরিক হয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাসিক (ভারপ্রাপ্ত) মেয়র মো. আসাদুর রহমান কিরন, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. আজমত উল্লাহ খান, গাজীপুর পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ:
আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লি ও আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে, টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের মাঠসহ বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
যৌতুক বিহীন বিয়ে:
গাজীপুরের টঙ্গীর কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের তীরে শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে আলমি শূরার তত্ত্বাবধানে (জুবায়েরপন্থি) মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনে শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার বিকালে ইজতেমা মাঠে তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ী এই যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করা হয়। সকাল থেকেই অভিভাবকরা পাত্র-পাত্রীদের নাম তালিকাভুক্ত করাতে শুরু করেন। পরে বাদ আছর ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম-উত্তর দিকে দোয়া মঞ্চ থেকে এসব বিয়ে পড়ান ভারতের মাওলানা জুবায়রুল হাসানের ছেলে মো. জোহায়রুল হাসান।
কনের সম্মতিতে বর ও উভয় পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে হয় এই বিয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বয়ান মঞ্চ থেকে মোনাজাতের মাধ্যমে নব দম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধি কামনায় দোয়া করা হয়।
টিভির মাধ্যমে মোনাজাত:
আখেরি মোনাজাতের সময় ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু নিজ নিজ বাসায় টিভির সামনে বসে এক কাতারে মোনাজাতে অংশ নেন।
১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মানব বলয়:
৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা প্রথম পর্বে তিন দিনব্যাপী শেষ দিন রবিবার ভোর থেকেই আখেরি মোনাজাতে শামিল হতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ রাজধানী ঢাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, জিপ, কার এবং নৌকাসহ নানা ধরনের যানবাহনে এবং পায়ে হেঁটে ইজতেমা ময়দানে পৌঁছেন। এছাড়া ভোর থেকেই ইজতেমা ময়দানের দক্ষিণে খিলক্ষেত, ঢাকার বিশ্বরোড থেকে উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা, পূর্বে পূবাইল, পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত রিকসাসহ সকল ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখার ফলে সকাল থেকেই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ইজতেমা অভিমুখে ছুটতে থাকে মুসল্লিদের কাফেলা। এতে তুরাগের তীরকে কেন্দ্র করে কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশাল মানব বলয় সৃষ্টি হয়। মোনাজাত শুরুর আগেই সকাল ৯টার মধ্যে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তুরাগ তীর।
নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে পুরো ময়দানে প্রায় তিন’শ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ইজতেমায় মুসল্লিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল নির্ধারিত পোশাকের বাহিরে সাদা পোশাকে মোতায়েন ছিল পুলিশ।
বিদেশি মুসল্লিদের জন্য তাশকিল কামরা:
ইজতেমা ময়দানের উত্তর পশ্চিম কর্ণারে করা হয়েছে বিদেশি মুসল্লিদের অবস্থানের জন্য তাশকিলের কামরা। ময়দানের খিত্তাগুলো থেকে চিল্লায় নাম লেখানো ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জামাতবন্দি করে তাশকিলের কামরায় জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। আখেরি মোনাজাত শেষে এসব মুসল্লিগণ জামাতবন্দি হয়ে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে গিয়ে রিপোর্ট করে তাবলীগের মুরুব্বীদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জামাতবন্দি হয়ে দ্বীনের দাওয়াতী মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাতবন্দিদের মধ্যে ৪০ দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারী মুসল্লিগণ রয়েছেন। তারা বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ করবে।
ব্যবস্থাপনায় মুসল্লিদের সন্তুষ্টি:
এবারের বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা কার্যক্রমে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজিরবিহীন সুশৃঙ্খল আইনশৃঙ্খলায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। জয়পুরহাট থেকে আগত মুসল্লি হাফেজ তোফাজ্জল হোসেন জানান, মুসল্লিদের যাতায়াতের দুর্ভোগে ইজতেমায় অংশ নিয়ে ইজতেমা ময়দানে ৩দিন অবস্থান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যে নজিরবীহিন নিরাপত্তা দিয়েছে তাতে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এছাড়াও মুসল্লিদের মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবা কার্যক্রমে মুসল্লিরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, সরকার ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সেবাদানে ইজতেমা ময়দানের অবকাঠামো উন্নয়নসহ যাবতীয় সেবা কার্যে যতটা সম্ভব সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে কাজ করেছেন।
উল্লেখ্য, ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে প্রথম পর্বের (আলমি শূরার) বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি হয়েছে। মাঝে ৪দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের অনুসারী (সাদপন্থী) মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয়পর্বে অংশ নেবেন। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে।