হাওরাঞ্চলকে দেশের শস্যভাÐার বিবেচনা করা হয়। দেশে উৎপাদিত বোরো ধানের প্রায় এক-চতুর্থাংশই উৎপন্ন হয় হাওরগুলোতে। এলাকার কয়েক লাখ কৃষকের একমাত্র ফসলও এটি। আগাম বন্যায় এই ধান নষ্ট হলে কৃষকদের দুঃখ-কষ্টের কোনো সীমা থাকে না।
গত মৌসুমেও আগাম বন্যায় ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এর পরও এ বছর হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত নিয়ে চলছে ব্যাপক গড়িমসি। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, চলতি বছর হাওরে মোট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ১৯৩টি। প্রকল্পের কাজ শুরুর নির্ধারিত দিন ছিল গত ১৫ ডিসেম্বর। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী জানান, নির্ধারিত দিনে ২০ থেকে ২৫টি প্রকল্পের কাজ শুরু করা গেছে।
হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের মধ্যে এক ধরনের শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। কাবিটা নীতিমালা-২০১৭ অনুসারে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রাক্কলন শেষ করে ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রæয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো প্রাক্কলনের কাজ শেষ হয়নি। নির্ধারিত দিনে নামমাত্র কাজ শুরু হয়েছে। কাজেই এ বছরও ২৮ ফেব্রæয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বাঁধ নির্মাণ নিয়ে স্থানীয়দের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের মতে, বাঁধের কাজ ইচ্ছাকৃতভাবেই বিলম্বিত করা হয়। দেরিতে কাজ শুরু করা হলে কাজের মধ্যখানে উজানের পানি চলে আসে। তখন নামমাত্র কাজ করে বা না করেই পুরো টাকা লুটপাট করা যায়। লুটপাট কমাতে সরকার কাবিটা বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং কৃষকদের নেতৃত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসি গঠন করে তার মাধ্যমে কাজ করার নির্দেশনা দেয়। সেই পিআইসি গঠন নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। নীতিমালা অনুসারে মাঠ পর্যায়ে গণশুনানি করে কৃষকদের মতামতের ভিত্তিতে পিআইসি গঠন, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনা রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পাউবো এবং উপজেলা প্রশাসনের পছন্দের লোকদের নিয়েই পিআইসি গঠন করা হয়। ফলে বাঁধ নির্মাণকাজে অনিয়ম করা অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণে সরকারের শত শত কোটি টাকা খরচ হলেও তা হাওরবাসীর খুব একটা উপকারে আসে না। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও হাওরের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে করা লুটপাটের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াÑএই সাতটি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল। এসব এলাকার লাখ লাখ কৃষক এবং হাজার হাজার কোটি টাকার ফসলের চেয়ে কিছু ঠিকাদার কিংবা প্রকৌশলী-কর্মকর্তার স্বার্থ বড় হতে পারে না। কেন প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে একই অনিয়মের অভিযোগ উঠবে? কেন নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু ও শেষ করা যাবে না? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত যেটুকু কাজ হবে, সেটুকু কাজের অর্থ পরিশোধ করা হবেÑএই নীতি অবলম্বন করলেই দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে। সেটি কেন করা হচ্ছে না? আমরা চাই, প্রকল্পের কাজ সময়মতো শুরু ও শেষ করা হোক।