বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। দিনটি ছিল মিত্রবাহিনীর সামনে শুধুই ঢাকা দখলের লড়াই। সবদিকে দিয়ে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাইরে থেকে হানাদার বাহিনীর প্রবেশ রুদ্ধ হয়ে যায়। মিত্রবাহিনী একে একে আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর ও ময়মনসিংহ দখলে নিয়ে নেয়।
একাত্তরের এইদিনে সকালবেলা হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে প্রথমবারের মতো জেনারেল নিয়াজী স্বীকার করেন, পরিস্থিতি নিদারুণ সংকটপূর্ণ। আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে পুনর্বিন্যাসকরণ সম্ভব নয় বলে একটি সংকেতবাণীও পাঠানো হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। দ্রুত মুক্ত হতে থাকে একের পর এক জায়গা।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার পদক্ষেপ নেয়। আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে আদেশ দেন। উদ্দেশ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া।
তবে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কারণ বীর সন্তানদের মনোবল ভেঙে দেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। মুক্তিযুদ্ধের এইদিনে যে জায়গাগুলো শত্রুমুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো- দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোণা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা।
দাউদকান্দি শত্রমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এর আগে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
নেত্রকোনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবদুল মতিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযদ্ধে আমি একজন প্লাটুন কমান্ডার ছিলাম। ৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে আমি আমাদের প্লাটুনের কিছু সৈনিকসহ নেত্রকোনা আসি। এরপরে হঠাৎ করে মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন চৌহান আমার কাছে একটি সংবাদ পাঠান। তিনি আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেন। আমি সেখানে যাওয়ার পরে চৌহান আমাকে জানালেন, নেত্রকোনায় থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করতে হবে। এবং সেই হামলা হবে টাইগার গ্রুপের আবু সিদ্দিক আহমেদের নেতৃত্বে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ৮ তারিখ সন্ধ্যার পর শত্রুবাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য রওনা হই। সেখানে আমরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করি। যার মধ্যে একটা ছিল কাভারিং পার্টি। সেটা ক্যাপ্টেন চৌহানের নেতৃত্বেই ছিল। এটা রাজারবাজারের আশাপাশেই ছিল। আবু সিদ্দিক আহমেদসহ আমরা নেত্রকোনা আক্রমণের জন্য এগুতে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আরেকটা কাভারিং পার্টি ছিল। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন নিয়ে বাঙ্গার আনোয়ার মাস্টার গ্রুপ ছিল সেই কাভারিংয়ে। আমরা সারারাত সেখানে অবস্থান করি। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। ফজরের একটু আগে আবু সিদ্দিক আহমেদ একটা পিস্তল নিয়ে আকাশে গুলি করেন। এটাকে আসলে বলা হয় চ্যালেঞ্জ দেওয়া। যাতে সেখানে কেউ থাকলে যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। তখনও কোনো প্রতিউত্তর পাওয়া যায়নি। কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের উপরে আক্রমণ চালানো হয় ফৌজদারি ব্রিজের উপরে থাকা বাঙ্কার থেকে। এর পরে সেখানে বেশ ভালোই যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে আবু সিদ্দিক আহমেদ সাহেবের আঙ্গুলে গুলি লাগে। এরপরে তার সৈন্যরা আমাদের গ্রুপের দিকে চলে আসেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার গ্রুপের ১৫ থেকে ২০ জন নিয়ে তখন আমাদের অবস্থান ছিল মদনপুর রাস্তার কাছে। আমার ডানে ছিলেন আবদুল জব্বার আবু খাঁ। উনি আমার মামা। তিনি হঠাৎ করে বলেন, ওই যে দেখা যায়, মামা একটাকেও আজকে ছাড়তাম না। এই বলেই তিনি মদনপুর রাস্তা পার হয়ে তাদের উপরে আক্রমণ করতে যান। তখনই তার উপরে গুলি করে পাকিস্তানিরা। এরপরেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেদিন প্রথম শহিদ হন তিনি। আমার বামে ছিলেন আবদুস সাত্তার। তিনি আমাকে বললেন, আবু খাঁ কে গুলি করেছে তাকে তো হাসপাতালে নিতে হবে। আর সিদ্দিকের লোকেরা তো চলেই এসেছে। আমি বললাম, এখন এগুনো ঠিক হবে না। কারণ যারা এখন আছি তারা কিন্তু পাকিস্তানিদের সঙ্গে পুরোপুরি নাও কুলোতে পারি। কিন্তু সাত্তার কথা না শুনে বলে, না মামা আবু খাঁকে বাঁচাতেই হবে। এই বলে আমাকে ডিঙিয়ে সাত্তার আবু খাঁয়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। সেই সময় তার গায়েও গুলি লাগে। মুহূর্তের মধ্যে সেও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এই অবস্থায় আমরা পরিকল্পনা পরিবর্তনের কথা ভাবি। কারণ সিদ্দিকের লোকেরা নেই। তার উপর আমার ডান ও বামের দুজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। সেই সময় আমরা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিই।’
আবদুল মতিন বলেন, ‘সেখান থেকে আমরা পিছু হটি। কিন্তু আবদুর রশিদ আমাদের সঙ্গে আসতে পারেনি। তার হাত-পা ভাঙ্গা অবস্থায় ছিল। সে বলে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লোক স্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। কারণ কমান্ড যার করার কথা সেই আবু সিদ্দিক আহমেদ তো গুলিবিদ্ধ হয়ে আগেই চলে আসে। এই সময়ে কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হলে রশিদকে নিয়ে আসা যেত। পরে শুনেছি, সেই তিনজনকেই টেনে হিঁচড়ে ব্রিজ থেকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের গুলি করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপরে রাজাবাজারে থাকা ক্যাপ্টেন চৌহানের দল ভারী অস্ত্র নিয়ে ফায়ার করে। এই অবস্থাতে পাকিস্তানিরা বাঙ্কার ছেড়ে পালিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘সকালে দেখলাম হাটপাড়া থেকে আলবদর, রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনা সদসর‌্যা আসছে। সে সময় আমরা একটা বাড়িতে ছিলাম। সেখান থেকে আমরা একটা জংলায় গিয়ে পৌঁছি। পরে চৌহানের দল সেই অবস্থায় গুলি শুরু করে। এতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ তাদের দোসররা রাস্তা দিয়ে ক্রলিং করতে করতে শহরের দিকে যায়। পরে কলেজের দিক দিয়ে ময়মনসিংহের রাস্তা ধরে পালিয়ে যায় তারা। এভাবেই শক্রমুক্ত হয় নেত্রকোনা। আমরা সবাই শহরে গিয়ে নেত্রকোনা মুক্ত ঘোষণা করি। স্বাধীন নেত্রকোনায় উড়তে থাকে লাল সবুজের পতাকা।’
৯ ডিসেম্বর স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক হাসান মোরশেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘৩ ডিসেম্বরের পরবর্তী দিনগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন উইং বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে প্রবেশ করে। তাদের উপর নির্দেশ ছিল মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া। নয় মাসের গেরিলা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে মুক্তিবাহিনীর অলআউট অ্যাকশনে নামে। ফলে একের পর এক জনপদ মুক্ত হতে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ব্যক্তিগত শোক ও গৌরব আছে আমার পরিবারের। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানা মুক্ত করার শেষযুদ্ধে শহিদ হন আমার চাচা গেরিলা যোদ্ধা মতিউর রহমান। শেষের দিনগুলোর চুড়ান্ত যুদ্ধে এরকম শহিদ হয়েছেন অসংখ্য সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। সাথে ভারতীয় সৈনিকেরাও।’