কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্ব মহামন্দায় বাংলাদেশকে সাত সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেগুলো হলো- ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি সংকট, খাদ্য সংকট, ইউক্রেন সংকট, কোভিড এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা থেকে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এসব সংকট সমাধানে সুপারিশও দিয়েছে সংস্থাটি।
মূল্যস্ফীতির সমাধানে দেওয়া সুপারিশগুলো হলো নতুন ভোগ বাস্কেট করা, প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করা, নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ও কর কমানো, বাজারে মনোপলি নিয়ন্ত্রণ করা। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ উত্তরণ কোন পথে?’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সংগঠনটির পক্ষে এসব কথা বলা হয়। মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডির গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরে যারা বসবাস করছেন তাদের খাদ্যপণ্যের তালিকার ১৯টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য রয়েছে। যা মানুষের ভোগের মধ্যে সব থাকে। ঢাকায় ৪ সদস্যের একটি পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় সব খাদ্যসহ সার্বিক খরচ ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছিল ১৭ হাজার ৫৩০ টাকা, যা ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবরের খাদ্যপণ্যের মূল্য বিবেচনায় খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৪২১ টাকা।
অন্যদিকে মাছ ও মাংস বাদ দিয়ে কম্প্রোমাইজ ডায়েট হিসেবে ৪ সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। যা ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ছিল ৬ হাজার ৫৪১ টাকা। খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর আমদানি শুল্কের হার কমাতে পারলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমে আসত বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
মূল প্রবন্ধে মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ও বহিঃখাত এ তিনটি বিষয় তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ঐতিহাসিক (ভয়াবহ) অবস্থায় চলে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। খাদ্যসংকটের আভাস স্পষ্ট। এ জন্য স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করে সিপিডি। প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির লাগামহীন অবস্থা। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি। এটা কমার কোনো লক্ষণ নেই। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুইটি কাছাকাছি অবস্থান করছে। তবে বাজারের চিত্রে দেখা যায়, পণ্যমূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য প্রকৃত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা উচিত। বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় চারজনের একটি পরিবারে ২২ হাজার ৪২১ টাকা খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে। মাছ-মাংস বাদ দিলেও ৯ হাজার ৫৯ টাকা লাগবে।
এটা কম্প্রোমাইজ ডায়েট বা আপোসের খাদ্যতালিকা। বেতন প্রতিবছর ৫ শতাংশ বাড়লেও সেটা ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। ২৯টি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে করহার অনেক বেশি। এ জন্য এটার প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপর। ১০ থেকে ৯০ শতাংশ কর রয়েছে। এটা কমানো গেলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমত। আমদানি খরচ বেশি। এ জন্য আমদানিতে বিকল্প বাজার দেখতে হবে। পণ্য আনতে গেলে ভারত ছাড়া সব দেশ থেকে খরচ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তি পকেট থেকে ব্যয় করে বেশি। সরকার খরচ করে কম।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সংকটগুলোর মধ্যে ডলার, জ্বালানি, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকটের কারণে অন্য সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সার্বিকভাবে সাতটি সংকট আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড. ফাহমিদা বলেন, মূল্যস্ফীতির সমাধানে সব শিল্পে ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।
এছাড়া ব্যক্তি খাতেও যারা কাজ করছেন, তাদের জীবনমানে এত ধস নেমেছে যে, এ আয় দিয়ে তারা চলতে পারছেন না। তাদের বেতনও পুনর্বিবেচনা করতে হবে। ‘সরকার ওএমএসসহ যেসব পণ্য দিয়েছে, তা সারাদেশে সহজলভ্য করতে হবে। এখানে দুর্নীতি যেন না হয়, সেটাও দেখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, একেবারেই দরিদ্রদের আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমপক্ষে ১ হাজার টাকা করতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
জ্বালানি সংকট সমাধানে সিপিডি বিভিন্ন কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগী হওয়া, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো ও দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে এখন বহুমুখী সংকট রয়েছে, তাই বহুমুখী নীতিমালাও প্রয়োজন। সব মন্ত্রণালয় এ বিষয়টির সঙ্গে জড়িত। সবার সমন্বয়ে একটি কমিটি থাকা প্রয়োজন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি চাকরিজীবী বা অন্য পেশার লোকজনকেও এ কমিটিতে রাখা উচিত।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিশ্ববাজারের জ্বালানির ভুক্তভোগী আমরা। কিছুদিন আগে মূল্য দিয়ে জ্বালানি পাওয়া গেলেও এখন সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না। লোডশেডিং ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল সব দেশ জ্বালানি আমদানি করে। ডলার-সংকটের কারণে আগস্ট থেকে অক্টোবর জ্বালানি আমদানি কমেছে। এ জন্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা গেছে।
সাধারণত ৬০ দিনের জ্বালানি মজুদ রাখা হয়। কিন্তু আমাদের ডিজেল ৬১ দিন, অকটেন ১৯ দশমিক ৬ দিন, পেট্রোল ৩৮ দশমিক ৪ দিন, ফার্নেস অয়েল ২৭ দশমিক ৯ দিনের মজুদ আছে। বিপিসির হাতে ২৩ হাজার কোটি টাকা আছে। টাকা একদম নেই বিষয়টা তেমন নয়। এ জন্য জ্বালানি তেলের দর পুনর্বিবেচনার দাবি জানান তারা। জ্বালানি তেলের ঘাটতি মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এটা দিয়ে আমদানি ব্যয় কীভাবে মেটানো হবে? কারণ সামনের দিনে ডলার-সংকটে খাদ্য আমদানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ডলার বাজারের যে অবস্থা সরকার কি খাদ্য আমদানি করবে নাকি অন্য খরচ মেটাবে, এটা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে।
আইএমএফের হিসাবে এটা প্রকৃত রিজার্ভ নয়। কারণ, এর থেকে ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ব্যয় বাবদ বাদ দিতে হবে। এ জন্য আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে যে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে সেগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সরকার। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য একটি রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যপণ্য কেনায় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, নিজের মজুদ নিশ্চিত না করে কোনো দেশ পণ্য রপ্তানি করতে চাইবে না। তাই ভবিষ্যতে ডলার থাকলেও বিশ্ববাজারে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য নাও থাকতে পারে। এ সময় সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।