সৌমিত্র শেখর :
ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এক দিনের নয়। ১৯৫২-এর আন্দোলনের পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে এর ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাঙালির জন্য বিলম্বে হলেও এটি একটি বিজয় নিশ্চয়। কিন্তু এতেই তুষ্ট ছিলেন না বঙ্গবন্ধু।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন বুধবার জেলবন্দি বঙ্গবন্ধু শহীদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে স্রষ্টার কাছে নীরবে প্রার্থনা করেন এবং অন্তরের মণিকোঠায় নেন সুদৃঢ় সংগ্রামের শপথ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মুর্তাজা আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার প-িতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা চালু হবে, তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয় তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে। ’ তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন।
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ পায় এবং বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। নির্দিষ্ট দিনে নিউ ইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় তাঁকে বক্তৃতার জন্য আহবান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে এগিয়ে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ান গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের খুব চিরচেনা চশমা, আর ব্যাকব্রাশ করা চুলে অপরূপভাবে। এমন একজন সুদর্শন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর আগে বিশ্ব খুব কমই দেখেছে। দীর্ঘদেহী, চৌকস, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ এক সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছিলেন সেদিনের বিশ্বনেতারা। এরপর তাঁর ভরাট গলায় বাংলা উচ্চারণ! ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এক বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে উঁচু আসনে তুলে ধরেছিলেন, তার ৬১ বছর পরে আরেক বাঙালি বিশ্বসভায় বাংলা ভাষাকে উঁচু আসনে তুলে ধরেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো। সেই পথও এভাবেই তৈরি হয় নিশ্চয়।
জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর দেহভঙ্গিমায় সবাইকে সম্মান জানান এবং জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির পার্লামেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেই অধিবেশনে যোগদান করায় সবার মধ্যে সন্তুষ্টচিত্ত লক্ষ করেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে এই অধিবেশনে যোগদান বিশেষ সফলতারই দ্যোতক। এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শুধু ১৯৭১-এর বাংলাদেশকেই তুলে ধরেননি, বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার ত্যাগ, কোন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রটির এসব ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে বক্তৃতায়। বক্তৃতার শুরুতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাঙালি ‘জাতি’র কথা। তিনি জানেন, বাঙালি জাতির বাস শুধু নবগঠিত দেশ বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহারসহ বহির্বিশ্বেও। এটি জেনেই তিনি বলেছেন, বহু শতাব্দী ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মুক্ত জীবনযাপনের জন্য যে সংগ্রাম করে এসেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করেছে, তারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়ে বাস করার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিল। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। ’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি, কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয়কালের কথাও স্মরণ করে বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়সংগত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। তিনি বাংলাদেশে নানা বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির কথাও উল্লেখ করেন তাঁর ভাষণে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। তারপর একাধিকবার বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখেও পড়তে হয় দেশটিকে। এই বিপর্যয়ে সহায়তাদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা জানান জাতিসংঘের প্রতি। তবে তিনি বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বহু অনুন্নত দেশের অবস্থাও।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বের গরিব দেশগুলোর নেতার মতো বলেন, উন্নত বিশ্ব যদি সমন্বিতভাবে এগিয়ে না আসে, তাহলে বিশ্বে এমন করুণ অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, যার দৃষ্টান্ত মানব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি পুঁজির পাহাড় গড়া কিছু মানুষের কথাও উল্লেখ করে বলেন, এরই মধ্যে কিছু মানুষ পুুঁজির দাপটে বিত্তবৈভবের যে ভোগবাদী অবস্থান নিয়েছে, তারও উদাহরণ বিরল। বঙ্গবন্ধুর এই কথার মধ্যে কিন্তু তাঁর জীবনদর্শনও প্রতিফলিত হয়। তিনি শোষিতের নেতা এবং শোষক শ্রেণির কারণেই যে সমাজে সব সংকটের সূচনা এই কথা তিনি তাঁর বিশ্ব বক্তব্যে এভাবেই উল্লেখ করেন। আদতে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই বক্তৃতায় সমকালীন বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘একদিকে অতীতের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাতে হয়েছে, অন্যদিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। আজকের দিনের বিশ্বের জাতিগুলো কোন পথ বেছে নেবে তা নিয়ে সংকটে পড়েছে। এই পথ বেছে নেওয়ার বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়ে এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়িয়ে তুলে এগিয়ে যাব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাব, যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করে তুলবে এবং যে বিশ্ব কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারির মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়ে তোলার অবস্থা সৃষ্টি করবে। ’
বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সবার প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে। ’ রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত এই বাংলা বক্তৃতায় জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ববাসীর কাছে সগর্বে বিশেষভাবে তুলে ধরে। এই বাংলা বক্তৃতার সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করার রীতি চালু করেন।
লেখক : উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ।
সৌমিত্র শেখর
ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এক দিনের নয়। ১৯৫২-এর আন্দোলনের পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে এর ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাঙালির জন্য বিলম্বে হলেও এটি একটি বিজয় নিশ্চয়। কিন্তু এতেই তুষ্ট ছিলেন না বঙ্গবন্ধু।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন বুধবার জেলবন্দি বঙ্গবন্ধু শহীদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে স্রষ্টার কাছে নীরবে প্রার্থনা করেন এবং অন্তরের মণিকোঠায় নেন সুদৃঢ় সংগ্রামের শপথ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মুর্তাজা আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার প-িতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা চালু হবে, তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয় তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে। ’ তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন।
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ পায় এবং বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। নির্দিষ্ট দিনে নিউ ইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় তাঁকে বক্তৃতার জন্য আহবান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে এগিয়ে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ান গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের খুব চিরচেনা চশমা, আর ব্যাকব্রাশ করা চুলে অপরূপভাবে। এমন একজন সুদর্শন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর আগে বিশ্ব খুব কমই দেখেছে। দীর্ঘদেহী, চৌকস, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ এক সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছিলেন সেদিনের বিশ্বনেতারা। এরপর তাঁর ভরাট গলায় বাংলা উচ্চারণ! ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এক বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে উঁচু আসনে তুলে ধরেছিলেন, তার ৬১ বছর পরে আরেক বাঙালি বিশ্বসভায় বাংলা ভাষাকে উঁচু আসনে তুলে ধরেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো। সেই পথও এভাবেই তৈরি হয় নিশ্চয়।
জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর দেহভঙ্গিমায় সবাইকে সম্মান জানান এবং জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির পার্লামেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেই অধিবেশনে যোগদান করায় সবার মধ্যে সন্তুষ্টচিত্ত লক্ষ করেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে এই অধিবেশনে যোগদান বিশেষ সফলতারই দ্যোতক। এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শুধু ১৯৭১-এর বাংলাদেশকেই তুলে ধরেননি, বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার ত্যাগ, কোন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রটির এসব ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে বক্তৃতায়। বক্তৃতার শুরুতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাঙালি ‘জাতি’র কথা। তিনি জানেন, বাঙালি জাতির বাস শুধু নবগঠিত দেশ বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহারসহ বহির্বিশ্বেও। এটি জেনেই তিনি বলেছেন, বহু শতাব্দী ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মুক্ত জীবনযাপনের জন্য যে সংগ্রাম করে এসেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করেছে, তারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়ে বাস করার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিল। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। ’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি, কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয়কালের কথাও স্মরণ করে বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়সংগত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। তিনি বাংলাদেশে নানা বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির কথাও উল্লেখ করেন তাঁর ভাষণে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। তারপর একাধিকবার বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখেও পড়তে হয় দেশটিকে। এই বিপর্যয়ে সহায়তাদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা জানান জাতিসংঘের প্রতি। তবে তিনি বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বহু অনুন্নত দেশের অবস্থাও।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বের গরিব দেশগুলোর নেতার মতো বলেন, উন্নত বিশ্ব যদি সমন্বিতভাবে এগিয়ে না আসে, তাহলে বিশ্বে এমন করুণ অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, যার দৃষ্টান্ত মানব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি পুঁজির পাহাড় গড়া কিছু মানুষের কথাও উল্লেখ করে বলেন, এরই মধ্যে কিছু মানুষ পুুঁজির দাপটে বিত্তবৈভবের যে ভোগবাদী অবস্থান নিয়েছে, তারও উদাহরণ বিরল। বঙ্গবন্ধুর এই কথার মধ্যে কিন্তু তাঁর জীবনদর্শনও প্রতিফলিত হয়। তিনি শোষিতের নেতা এবং শোষক শ্রেণির কারণেই যে সমাজে সব সংকটের সূচনা এই কথা তিনি তাঁর বিশ্ব বক্তব্যে এভাবেই উল্লেখ করেন। আদতে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই বক্তৃতায় সমকালীন বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘একদিকে অতীতের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাতে হয়েছে, অন্যদিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। আজকের দিনের বিশ্বের জাতিগুলো কোন পথ বেছে নেবে তা নিয়ে সংকটে পড়েছে। এই পথ বেছে নেওয়ার বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়ে এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়িয়ে তুলে এগিয়ে যাব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাব, যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করে তুলবে এবং যে বিশ্ব কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারির মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়ে তোলার অবস্থা সৃষ্টি করবে। ’
বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সবার প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে। ’ রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত এই বাংলা বক্তৃতায় জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ববাসীর কাছে সগর্বে বিশেষভাবে তুলে ধরে। এই বাংলা বক্তৃতার সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করার রীতি চালু করেন।
লেখক : উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ।