দেশে বেড়েছে করোনা সংক্রমণ, ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনার নতুন সংক্রমণের সংখ্যা সারাবিশ্বে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, করোনা মহামারী সমাপ্তির পথে রয়েছে। একই সঙ্গে করোনায় সবচেয়ে বিধ্বস্ত হওয়া দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও বলেছেন, দেশটিতে করোনা আর মহামারী আকারে নেই। বিশ্বজুড়ে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানির পর এটি একটি স্বস্তির খবর। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রকম স্বস্তির খবর দিলেও দেশে আবারও বাড়ছে ভাইরাসটির সংক্রমণ। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই উর্ধমুখী রয়েছে ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা। শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। এমন অবস্থায় করোনা থেকে বাঁচতে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত মঙ্গলবার ৫৫ দিন পর ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে একদিনে ৫ জনের মৃত্যু হয়। আর বুধবার কারও মৃত্যু না হলেও শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৭৩ শতাংশে। অধিদফতর বলছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় শনাক্ত হয়েছে ৬৪১ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ১৯ হাজার ৪৭০ জনে। এই সপ্তাহের শুরু থেকে বুধবার পর্যন্ত ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন, ২ হাজার ৫১১ জন।
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আবারও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই করোনা থেকে বাঁচতে বাদ পড়া টিকাগ্রহীতাদের দ্রুততম সময়ের টিকার আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি সাধারণ মানুষজনকে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ তাদের।
গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগের দিন অর্থাৎ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, করোনা মহামারী শেষ করার জন্য আমরা কখনই ভাল অবস্থানে ছিলাম না। আমরা এখনও সেখানে নেই। কিন্তু করোনা মহামারীর শেষ দেখা যাচ্ছে। করোনাভাইরাসে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে গত সপ্তাহে সংক্রমণ সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। যদি আমরা এখন এই সুযোগটি গ্রহণ না করি, তাহলে আমরা ভাইরাসের আরও ভ্যারিয়েন্ট, আরও মৃত্যু, আরও বিধিনিষেধ এবং আরও অনিশ্চয়তার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাব।
এই পরিস্থিতিতে দেশগুলোকে ভাইরাসের লাগাম টেনে ধরতে যা করতে হবে তা করতে সাহায্য করার জন্য ছয়টি সংক্ষিপ্ত নীতি প্রকাশ করেছে ডব্লিউএইচও এ তথ্য জানিয়ে টেড্রোস বলেন, এসব নীতি সরকারগুলোর জন্য তাদের কৌশল আরও কঠোর করার এবং করোনা মহামারীর আশঙ্কাসহ ভবিষ্যতের রোগজীবাণুগুলো প্রতিরোধে তাদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য একটি জরুরী আহ্বান। একইসঙ্গে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোতে ১০০ শতাংশ টিকা দেয়ার এবং ভাইরাস শনাক্তের জন্য পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু ঠিক এই জায়গাটিতে কিছুটা স্থবিরতা বিরাজ করছে সম্প্রতি। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, দেশে এখনও প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ প্রথম ডোজের টিকার বাইরে রয়েছেন। আর দ্বিতীয় ডোজ নেননি ৯৪ লাখ মানুষ। তিনি এসব মানুষকে টিকা দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আগামী ৩ অক্টোবরের পর প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হবে না। তিনি বলেন, দ্বিতীয় ডোজও দেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। কারণ তখন হয়ত আমাদের কাছে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের জন্য টিকা থাকবে না। যেগুলো থাকবে সেগুলোরও মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তাই যারা এখনও প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ নেন নি তারা দ্রুত নিয়ে নিন। অক্টোবরের পরে থেকে টিকা নাও পেতে পারেন।
মন্ত্রী জানান, এখন পর্যন্ত দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৭৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ ১ম ডোজ, ৭১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ২য় ডোজ এবং মাত্র ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষকে বুস্টার (৩য়) ডোজ দেয়া হয়েছে। আর তড়িঘড়ি করে শুরু হওয়া শিশুদের টিকা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১০ লাখ ডোজ দেয়া হয়েছে। এখনও বাকি আরও ৪ কোটি শিশু। আগামী ১১ অক্টোবর থেকে দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিশুদের টিকাদান শুরু হলেও স্বাস্থ্য বিভাগের মাত্র সোয়া চার লাখ টিকার সংস্থান করতে পেরেছে বলে জানা গেছে।
বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্র করোনা মহামারীর সেই ভয়াল অধ্যায় পেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেছেন, আমার মনে হয় দেশের পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসছে। আমরা মহামারীর সেই ভয়াল অধ্যায় পেছনে ফেলে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্রে মহামারী শেষ হয়েছে। কিন্তু এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সংক্রমণের পরিসংখ্যান তৈরি করছে আতঙ্ক।
এসব বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। টিকার মাধ্যমে তৈরি হওয়া হার্ড ইমিউনিটির নিশ্চয়ই একটা সময় রয়েছে। এমন যাদের প্রথম ডোজের টিকা নেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেয়া হয়নি স্বাভাবিকভাবেই তাদের ইমিউনিটি দুর্বল হয়ে যাবে। একইভাবে বুস্টার ডোজের টিকা না নিলেও ইমিউনিটি ঠিক কতটা থাকবে বোঝা মুশকিল। তাছাড়া, সংক্রমণ কমে যাওয়ায় আমাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপন এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মানুষজন কোনোধরণেরই স্বাস্থ্য বিধি মানছেন না। এমনকি মাস্কও ব্যবহার করছেন না। আর এতে করেই আবারও দেশে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। কিন্তু আমি মনে করি এই আক্রান্তের সংখ্যা আতংকিত হওয়ার মতো কিছু নয়। জ্বর হলে পরীক্ষা করাতে হবে। নিজেদের পরিবার থেকে আলাদা রাখতে হবে।
বাদ পড়া মানুষদের টিকার আওতায় নিয়ে আসতে টিকা কর্মসূচীকে গণমুখী করার তাগিদ দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালকা ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ তার এক প্রতিবেদনে বলেন, টিকায় ঈর্ষণীয় সাফল্য পাওয়া দেশ করোনা টিকাদানে কাঙ্কিত সাফল্য পাবে না, এটা আদৌ কাক্সিক্ষত নয়। পরীক্ষিত ক্লাস খেলোয়াড় ঘরের মাঠে মুখ থুবড়ে পড়বে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। চার দশক ধরে নবজাতক শিশু-কিশোরী মায়েদের মন জয় করেছে ইপিআই কর্মসূচী। কেন করোনা টিকা গণমুখী হলো না প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এর ফলে অসংখ্য মানুষ টিকাবহির্ভূত থাকল, ইপিআই টিকাদান প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দেড় মাস বয়সী শিশু থেকে গর্ভবতী মহিলাদের মেলবন্ধনে যুক্ত করতে পারলেও কেন আমাদের বয়স্কদের তা করা গেল না, তার কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করা যেতে পারে।
টিকাকে কেন গণমুখী করা হলো এই প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর ও টিকাদান কর্মসূচীর সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ শামসুল হক বলেন, ইপিআইয়ের টিকাদান কর্মসূচীর একটা জন্য আমাদের নির্দিষ্ট একটা বয়সসীমা ছিল। কিন্তু করোনার জন্য তা ছিল না। আর আমাদের জনবলও এতটা নেই যে এই কাজটা করা সম্ভব হবে। আমাদের প্রতিটা জেলা-উপজেলার কেন্দ্রেই টিকা দেয়া হচ্ছে। যা মানুষের দোরগোড়ায়ই বলতে গেলে। এখন কেউ যদি টিকা নিতে না আসে তাহলে আমাদের আর কি করার আছে। এক্ষেত্রে বাকি থাকা টিকাপ্রত্যাশীদের জন্য শিগগীরই বড় কোনো কর্মসূচি নেয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত আমরা এটি নিয়ে কিছু ভাবছি না। কোন সিদ্ধান্ত হলে আপনাদের নিশ্চয়ই জানিয়ে দেয়া হবে।
এদিকে সম্প্রতি করোনা আবার উর্ধমুখী হওয়া এর সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণসহ পাঁচটি সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিট। সুপারিশমালায় আবারও সবক্ষেত্রে সঠিকভাবে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, আবারও হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে জনসাধারণকে উৎসাহিত করতে হবে। যারা করোনা টিকার প্রথম, দ্বিতীয় এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ করেননি তাদের টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, বন্ধ স্থানে সভা করা থেকে বিরত থাকা ও দাফতরিক সভা যথাসম্ভব ভার্চুয়ালি করা, অপরিহার্য সামাজিক অনুষ্ঠান বা সভায় মাস্ক পরিধান করা, বেসরকারী পর্যায়ে কোভিড পরীক্ষার ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এসব বিষয় না মানলে পরিস্থিতি আবারও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে বিশ্বের প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনাটিও ঘটেছিল চীনে। তারপর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। কিন্তু তাতেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে ওই বছরের ১১ মার্চ করোনাকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে ডব্লিউএইচও।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মহামারী শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৬১ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২১ জন এবং এ রোগে মৃত্যু হয়েছে মোট ৬৫ লাখ ৩১ হাজার ৯০৯ জনের।