তৃতীয় ধাপে কোন পথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কয়েক মাস ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনারা দেড় হাজার মাইল রণক্ষেত্রে নির্মম যুদ্ধে লড়ছে। হতাহতের ঘটনা বাড়ছে, লড়াই পৌঁছে যাচ্ছে ক্লান্তিকর পর্যায়ে এবং কোনও পক্ষ ভূমি দখলের অগ্রগতি অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে কেউ পিছু হটতেও রাজি না।
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় অঞ্চলে ভূমি দখল এবং রাজধানী কিয়েভ দখলে ব্যর্থতার পর পূর্বাঞ্চলে রক্তক্ষয়ী কামান যুদ্ধে মনোযোগ দেয় রাশিয়া। ছয় মাস এখন চলমান যুদ্ধ তৃতীয় ধাপে গড়াচ্ছে। এই পর্যায়ের শুরুতে যুদ্ধে অচলাবস্থা, শত্রুতা চরম পর্যায়ে এবং অচলাবস্থা ভাঙতে কবে ও কখন ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ শুরু করবে তা নিয়ে অনিশ্চিত উদ্বেগ বিরাজমান।
এমন পাল্টা আক্রমণের সময় নির্ধারণ করা ইউক্রেন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষই দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এমন দীর্ঘ যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারাতে ইউক্রেনের জন্য সুবিধাজনক। কারণ গ্রীষ্মে বৃষ্টির মৌসুমে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চল দুর্গম হয়ে পড়ে কিংবা জ্বালানির ঘাটতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ইউরোপীয় সমর্থনে ভাটা পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় অবস্থিতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সি.এন.এ-এর রুশ গবেষণা পরিচালক মাইকেল কফম্যান ইউক্রেনের অবস্থান পর্যালোচনায় বলেন, আক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ। যদি ব্যর্থ হয় তাহলে বাইরের সহযোগিতায় প্রভাব পড়বে। অপর দিকে, কিয়েভ এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। কারণ এর বিপরীতে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে লড়াই করা লাগতে পারে।
ইউক্রেনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধ অনন্তকাল চলতে পারে না। দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে থাকা মানে ইউক্রেনের অর্থনীতির পঙ্গু হয়ে যাওয়া। যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে দেশটি পশ্চিমা সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এর ফলে রাশিয়া দখলকৃত অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করার সময় ও সুযোগ পেয়ে যাবে। ইতোমধ্যে মিডিয়ায় ও স্কুলের পাঠ্যসূচিতে রুশ প্রোপাগান্ডার প্রচার শুরু হয়েছে, বিরোধীদের গ্রেফতার বা তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং লজ্জাজনক গণভোট আয়োজনের মধ্যে দিয়ে ভূখণ্ডগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হতে পারে।
রণক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ার কারণে রাশিয়াতে কিছু রাজনৈতিক চাপের মুখে রয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিশেষ করে রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়ায় ইউক্রেনের হামলা এবং গত সপ্তাহে গাড়িবোমায় জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষক ও পুতিন ঘনিষ্ঠের মেয়ে নিহত হওয়ার পর চাপ বেড়েছে। এই হামলা দুটির পর রাশিয়ার যুদ্ধবাজরা প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
কিন্তু বেশ কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, পুতিন এসব দাবি উপেক্ষা করে যাবেন এবং এমন একটি কৌশলে স্থির থাকবেন যাতে ইউক্রেনীয়রা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর পক্ষে সর্বশেষ ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বৃহস্পতিবার। ওই দিন পুতিন একটি ফরমান জারি করেছেন যাতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে আরও ১ লাখ ৩৭ হাজার সেনা নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে রুশ সেনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১১ লাখ ৫০ হাজার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিনের ফরমান ইঙ্গিত দেয় পুতিন একটি দীর্ঘমেয়াদী ও নাকাল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বিপুল সংখ্যায় সেনাবাহিনীতে সদস্য নিয়োগ যুদ্ধে বড় কোনও পরিবর্তন আনবে না। হয়ত দেশে কিছুটা বিরোধিতার জন্ম দেবে।
মস্কোভিত্তিক বেসরকারি থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর অ্যানালাইসিস অব স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড টেকনোলজিস-এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক রুসলাম পুখব বলেন, বড়দিন বা আগামী বসন্তে যুদ্ধের অবসানের প্রত্যাশা করা ভুল। আমার মনে হয় এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে।
এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের সামরিক প্যাকেজের ঘোষণায় ইউক্রেনের শক্তি বাড়বে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এই সহযোগিতা পুতিনের প্রতি একটি বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র এর মাধ্যমে বলতে চাইছে যে, তারা দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনের পাশে রয়েছে এবং ন্যাটোকে নিয়ে তারা অনির্দিষ্টকাল সহযোগিতা দিয়ে যাবে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বারবার বলছেন, বাইডেন ইউক্রেনকে যুদ্ধে জিততে সহযোগিতায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। এমনকি তা যদি বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধেও গড়ায়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিরক্ষানীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি কোলিন এইচ. কাহল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দীর্ঘ এই খেলায় পুতিন জয়ের যে কল্পনা করছেন তা রাশিয়ার আরেকটি ভুল হিসাব।
একটি রুশ সামরিক জার্নালের সম্পাদক ইগো করোতচেঙ্কো বলেন, ইউরোপে রুশ পর্যটকদের সংখ্যা কম হবে। কিন্তু রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ছে ১ লাখ ৪০ হাজার। আমার ধারণা এটি শুরু মাত্র।
পুতিন দীর্ঘমেয়াদী অচলাবস্থায় ভরসা রাখলেও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একভাবে সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি জাগোরুদনিয়ুক বলেন, আমাদের অর্থনীতি খুব কঠিন পরিস্থিতি, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঝুঁকি এবং যুদ্ধের প্রতিকূলতা সাধারণ মানুষের হাঁপিয়ে ওঠা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যাবে। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর উচিত প্রতিরক্ষার বদলে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, যুদ্ধকে বছরে দীর্ঘায়িত করার কোনও অর্থ হয় না।
রুশ অধিকৃত অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাজানো গণভোট আগামী মাসের শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। এতে করে পাল্টা আক্রমণ শুরুর জন্য জেলেনস্কির ওপর চাপ আরও বাড়ছে।
কিন্তু কয়েকজন সামরিক বিশ্লেষক বলছেন, এই বিষয় নিয়ে ইউক্রেনের বেসামরিক ও সামরিক নেতাদের মধ্যে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। বেসামরিক নেতৃত্ব একটি বড় জয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু সামরিক নেতারা চাইছেন বড় আকারের পাল্টা আক্রমণ শুরুর আগে পর্যাপ্ত সেনা ও লড়াইয়ের শক্তি অর্জন করতে।
লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতায় ইউক্রেন যে শুধু টিকে থাকবে তা নয়, জয়ীও হতে পারে– এমনটি দেখানোর তাড়া রয়েছে। ইউক্রেনীয় জনগণের মধ্যে প্রত্যাশা রয়েছে যে তারা নিজেদের ভূখণ্ড রুশ দখলমুক্ত করতে পারবে।
কিন্তু তিনি সতর্ক করে বলছেন, একটি সামরিক আক্রমণ রণক্ষেত্রের পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি পরিকল্পনা করতে হয়, রাজনৈতিক অঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়।