কাজিরবাজার ডেস্ক :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের উপস্থিতি ধরে নিয়েই বিজয়ের ছক কষছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। টানা তিন জাতীয় নির্বাচনে নৌকার বিজয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে সারাদেশে নৌকার গণজোয়ার সৃষ্টি, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিতর্কিতদের ঝেরে ফেলে জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদানসহ বিভিন্ন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। পাশাপাশি নির্বাচন সামনে রেখে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের নামে কোন ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হলে বিএনপিকে এক বিন্দুও ছাড় না দেয়ার কৌশলও রয়েছে দলটির।
শোকের মাস আগষ্টের কারণে সম্মেলনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দলকে ঢেলে সাজানোর কর্মকান্ড স্থগিত থাকলেও সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে কোমর বেঁধে মাঠে নামবে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। আগামী ডিসেম্বর দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ সকল জেলা-মহানগর-উপজেলার সম্মেলন শেষ করার টার্গেট রয়েছে দলটির। সম্মেলনের মাধ্যমে সারাদেশে দলকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠ জরিপের কাজও শুরু করেছে দলটি। আর এ গোপন মাঠ জরিপের কাজ স্বয়ং মনিটরিং করছেন দলটির প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দল হিসেবে সবসময়ই নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি থাকে। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে বিএনপি যত কথাই বলুক না কেন, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা নির্বাচনে আসবে। আর সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক ও জনগণের জনমত প্রতিফলিত হোক এমন নির্বাচনই আমরা চাই।
তিনি প্রতিক্রিয়ায় আরও বলেন, কোন দল নির্বাচনে না এলে তো নির্বাচন বসে থাকবে না। সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি এবং আমাদের দলকে তৃণমূল থেকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করে দিয়েছি। শোকের মাসের কারণে আমাদের কিছু কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে সারাদেশেই সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা, সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতিগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করা হবে। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে কোন অপশক্তি যাতে দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেজন্য সারাদেশে নেতাকর্মীদের সজাগ-সতর্ক থাকার পাশাপাশি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতেও বলা হয়েছে।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এবার প্রতিটি আসনেই শক্তিশালী, জনপ্রিয় এবং বিতর্কমুক্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে দলটি। একইসঙ্গে কোন কোন আসনে জোটের প্রার্থীদের বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে তারও গোপন জরিপ চালানো হচ্ছে দলের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে। তবে টানা তিন মেয়াদে বিতর্কিত, জনবিচ্ছিন্ন, কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িত মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেরই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধশতাধিক আসনের মন্ত্রী-এমপিদের কপাল পুড়তে পারে এবং সেসব আসনে এবার নতুন মুখ দেখা যেতে পারে।
দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি ও তাদের সমমনা জোটগুলো মুখে যতই কথা বলুক, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। আর বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও রাজপথে গণতান্ত্রিক কর্মসূচী পালনে রাজপথের বিরোধী পক্ষকে অনেকটাই ছাড় দিতে চায় ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনে বিএনপি আসছে না- এমনটা মনে ধরে সাংগঠনিক ও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ন্যূনতম কমতি রাখবে না আওয়ামী লীগ। বিএনপি নির্বাচনে এলে তিনশ’ আসনে তাদের প্রার্থী কে হতে পারে, কোন আসনে বিএনপির প্রভাব বেশি- জরিপের মাধ্যমে তার তালিকা করে এসব আসনে আওয়ামী লীগের যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের বাছাইয়ের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
তবে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের আশঙ্কা, অতীতের মতো নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ডালপালা আরও বিস্তার করতে পারে। বিদেশীদের কাছে নানা মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিরও চেষ্টা করতে পারে। এসব ষড়যন্ত্রে সফল না হলে তারা অতীতের মতো নাশকতা-ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশে একটা বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টিরও চেষ্টা করতে পারে।
এসব কারণে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেপ্টেম্বর থেকেই তারাও নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে রাজপথে নিজেদের দখলে রাখবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের এ ব্যাপারে সর্বদা সজাগ-সতর্ক এবং জনগণের জানমাল রক্ষায় রাজপথেই বিরোধী পক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক-শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কেউ বাধা দেবে না। তবে অতীতের মতো অগ্নিসন্ত্রাস কিংবা নাশকতার চেষ্টা করা হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থাকতে বলা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগেই নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের পক্ষে, নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টির জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কোমর বেঁধে মাঠে নামবেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
সব বাধা কাটিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকেই এখন চোখ আওয়ামী লীগের। সরকারকে চাপে রেখে দাবি আদায়ে নির্বাচনে না আসার কথা মুখে বললেও আওয়ামী লীগ নিশ্চিত শেষ পর্যন্ত দলের অস্তিত্ব রক্ষায় নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং দেশ-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হোক সেটাও প্রত্যাশা দলটির হাইকমান্ডের। আর সে কারণে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনরূপ ঝুঁকি নেবে না আওয়ামী লীগ। রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তি ইমেজ দিয়ে পরাজিত করতে পারে এমন যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাদের হাতেই এবার নৌকা প্রতীক তুলে দিতে চান দলটি। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা বলছেন, তাদের কাছে খবর আছে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি ও এর সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে সেপ্টেম্বরের প্রথম থেকেই সারাদেশে মাঠে নামবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতারা সারাদেশের সেসব আসনে দ্বন্দ্ব-বিরোধী বা বিভক্তি রয়েছে সেখানে গিয়ে কিংবা ওইসব আসনের নেতাদের ঢাকায় তলব করে তা মীমাংসা করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করারও নির্দেশ রয়েছে দলটির হাইকমান্ডের তরফ থেকে।
এ ব্যাপারে দলের কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা জানান, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে বেশ কিছু আসনে নেতা ও এমপির একক আধিপত্য তৈরি হয়েছে। আবার কোথাও তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দলকে সাংগঠনিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেকে অভিমান থেকে দল থেকে দূরে সরে গেছেন। এ বিষয়গুলো নিয়ে দলের হাইকমান্ড থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কিছু গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফরে আগামী নির্বাচনের আগেই দলকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা চালানো হবে। বিএনপিকে দ্বাদশ নির্বাচনের মাঠে প্রধান প্রতিপক্ষ ধরেই রাজনৈতিক মাঠে প্রতিরোধ-লড়াইয়ের কৌশলও ক্ষমতাসীন দলটির রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা চতুর্থবারের মতো নৌকার বিজয় ধরে রাখতে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে এবার বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। এবার দলের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরাই প্রাধান্য পাবেন যাদের নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং জনপ্রিয়তা আছে। এ ক্ষেত্রে কোথাও কোন নেতার দলকে পাশ কাটিয়ে একাধিপত্য গড়ে তুলেছে, বিতর্কিত-দুর্নীতি কিংবা পারিবারিকতন্ত্র গড়ে তোলার সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারে এবার কড়া পদক্ষেপ নেবে দলটি। একইসঙ্গে দলকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ায় দলের নিবেদিত ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের নীতিও নিয়েছে দলটি।
আগামী নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে দলটির সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্য হচ্ছে, একটি নির্বাচনে জয়ের কিছু কারণ থাকে। প্রথমত দলের নির্বাচনী ইশতেহার বা কর্মসূচী, দ্বিতীয়তা প্রার্থী, তৃতীয়ত ঐক্যবদ্ধতা। এই তিনটি জিনিসের সমন্বয় হলে নির্বাচনে জয়লাভ হওয়া সুনিশ্চিত। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বিপুল জনপ্রিয়তা, আমাদের প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা এবং দলকে সুসংগঠিত করা- এই তিনটি বিষয়ের ওপর ভর করে আমরা নির্বাচনে জিততে চাই। আমরা মনে করি, যে কোন জোটই নির্বাচনে আসুক না কেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিক আসনে জয়লাভ করবে।