কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের কারাগারগুলোতে বন্দী নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের দুর্ধর্ষ দেড় শতাধিক জঙ্গি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। কারাগারের ভেতরে এরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এক সেল থেকে অন্য সেলে অবাধে যাতায়াত করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিভিন্ন মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে আনা-নেয়ার সময় তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে। গাড়িতে তোলার সময় তারা বেপরোয়া হয়ে কারা কর্মকর্তা ও রক্ষীদের নানাভাবে নাজেহাল করছে।
দীর্ঘদিন তারা কারাগারে আটক থাকায় চলাফেরায় উগ্র হয়ে উঠছে। যাকে তাকে লাঞ্ছিত করছে। এ নিয়ে ত্যক্ত ও বিরক্ত কারা কর্তৃপক্ষ। যে কোন সময় তারা কোন অঘটন ঘটাতে পারে। সম্প্রতি কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে অবহিত করেছে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরে একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। এ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশের কারাগারে বন্দী জঙ্গিদের যেসব মামলার তদন্ত এখন শেষ হয়নি তা দ্রুত শেষ করতে পুলিশ সদর দফতর থেকে পুুলিশের সব ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে রেঞ্জ ডিআইজি, ইউনিট প্রধান ও পুলিশ সুপাররা তৎপরতা শুরু করেছেন।
এর আগে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গিরা ট্রাক দিয়ে চলন্ত প্রিজন ভ্যান থামিয়ে, বোমা মেরে, গুলি চালিয়ে পুলিশ সদস্যদের হতাহত করে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত সহযোগী তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশের ৬৮ কারাগারে প্রায় ১৮শ’ জঙ্গি বন্দী রয়েছে। এদের মধ্যে দেড় শতাধিক ভয়ঙ্কর জঙ্গি বন্দী রয়েছে। তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কারা কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে অন্ততপক্ষে ১৩৭ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গি বন্দী আছে। বাকি জঙ্গিরা অন্য কারাগারগুলোতে বন্দী।
তাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে। আবার কিছু মামলা আদালতে বিচারাধীন। দিনের পর দিন তারা কারাগারে আটক থাকায় চলাফেরাতেও উগ্র হয়ে উঠছে। যেসব মামলা বিচারাধীন ও তদন্তাধীন সেগুলো সুরাহা হচ্ছে না। এসব মামলা দ্রুত শেষ করতে সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর থেকে একটি নির্দেশনা গেছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে।
নাম প্রকাশ না করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, কারাগারে বন্দী দুর্র্ধষ জঙ্গিদের নিয়ে কারা কর্মকর্তা, কারারক্ষীদের সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কারাগারের সেলগুলোতেও তারা সমস্যার চেষ্টা চালায়। এক সেল থেকে আরেক সেলে অবাধে যাতায়াত করে। কেউ কিছু বললে তাদের নাজেহাল করে ছাড়ে।
তাদের ধরে নিদিষ্ট সেলে নিয়ে গেলে চিৎকার চেচাঁমেচি করে। অনেক সময় হুমকি দিয়ে থাকে। আদালতে নেয়া ও আনার সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তারা। দুইপায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগিয়ে রাখার পর তারা প্রিজন ভ্যানে চিৎকার চেঁচামেচি করে। সম্প্রতি বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। কারা কারা এসব করছে তার একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারাগারে আটক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা হয়েছে। সেসব মামলায় যাতে দ্রুত চার্জশীট দেয়া হয়। সেজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জঙ্গিদের বিষয়ে আমরা সবসময় সতর্ক। জঙ্গি সংগঠনগুলো যাতে কোন ধরনের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে।
আটক জঙ্গিদের বিষয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছে কারা কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি এটিইউ, সিটিটিসি, র্যাব ও পুলিশ সব সময় জঙ্গিদের নজরদারিতে রাখছে। তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের গ্রেফতার করছে। দ্রুত চার্জশীট দিচ্ছে। এ ব্যাপারে আইজি প্রিজন এএসএম আনিসুল হকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানান, ১৯৯২ সালে আফগান ফেরত মুফতি আবদুর রউফ, মাওলানা আবদুস সালাম আর মুফতি আবদুল হান্নান গঠন করে হরকাতুল জিহাদ হুজি। ১৯৯৯ সালে হুজি কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা চালায়। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে দশজনকে হত্যা করে। হামলা করা হয় রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। ২০০৪ সালের মে মাসে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলা চালায় তারা।
হুজির সবচেয়ে বড় হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর তখন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যার পেছনেও ছিল হুজি। তাছাড়া জেএমবি, জেএমজেবিক তৎপরতা ছিল বেপরোয়া। ওই কর্মকর্তা জানান, ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ আবদুর রহমান এবং বাংলাভাই, মুফতি হান্নানসহ জেএমবির ও হুজির সাত নেতাকে ফাঁসি দেয়া হলেও সংগঠনের তৎপরতা এখনও আছে। বর্তমানে নব্য জেএমবির তৎপরতা আছে। পাশাপাশি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হিযবুত তাহরীরও এখনও সক্রিয় আছে। হলি আর্টিজানের হামলার পেছনেও ছিল জঙ্গিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চটগ্রাম, ঢাকা ও গাজীপুর কারাগারে থাকা জঙ্গিদের মধ্যে রয়েছে চুয়াডাঙ্গার আমিরুজ্জামান পারভেজ, সাবকাত আহম্মেদ, ফাহাদ বিন সোলাইমান, রাজশাহীর রাকিব হাসান প্রকাশ ওরফে খালিদ, হাবিবুর রহমান, নাটোরের তাহসীন, সাখাওয়াত হোসেন, কুমিল্লার কামরুল ইসলাম, নুরুল আলম, দিদারুল আলম, ময়মনসিংহের আবুল কাশেম, কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের ইউসুফ, হবিগঞ্জের নুরুল হক, মাওলানা আবু তাহের, মহিবুর রহমান, মৌলভীবাজারের আবদুল হক, বাগেরহাটের মমতাজ উদ্দিন, নাঈম, আসাদ, সোহাগ, চট্টগ্রামের রেজাউল, কিশোরগঞ্জের শরিয়তউল্লাহ, চাঁদপুরের মুসা আহম্মদ, কক্সবাজারের হাফেজ রফিকুল ইসলাম, রেজাউল করিম, হাফেজ সিরাজুল করিম, আনোয়ার উদ্দিন জাবেদ, ওসমান ও হাবিব, হুজি মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম, হাফেজ জাহাঙ্গির, আবদুর রহমান, গোপালগঞ্জের বোরহান উদ্দিন মাসুম, রাজবাড়ির হাফেজ আলী ইয়াস আহম্মদ, পটুয়াখালীর ইব্রাহিম ওয়ালিউল্লহ, গোপালগঞ্জের খালেদ, দিনাজপুরের রাশিদুল ইসলাম, চাঁদপুরের আবু জিহাদ, মাওলানা মামুনুর রশীদ, আবদুল খালেক হুরায়রা, আমির হোসাইন, ইসহাক, ঝালকাঠির লিটন আমির, আমিনুল ইসলাম হামজা, বরিশালের আমিনুল, নোয়াখালীর মোবাশ্বের সামাদ, প্রকাশ সামাদ, আজিজুল হক, ফেনীর আবদুল কাইয়ুম, মানছুর ইসলাম, চট্টগ্রামের জাবেদ ইকবাল, মোহাম্মদ, আমানউল্লাহ, বান্দরবানের আবু হুররার, শামীম হোসেন গালিব, রাঙ্গামাটির শামীম হোসেন, শামীম হাসান, বরগুনার এরশাদ হোসেন, নাটোরের মামুন, মাহবুব, মিনহাজুল ইসলাম, রাজশাহীর বাঘমারার সাজিল, শাহজাহান, খুলনার নুরনবী, বাগেরহাটের রাজু, রিয়াদ, রমজান আলী, ফরিদপুরের রাজু আহমেদ, আবদুল মান্নান, সুজন বাবু, কুমিল্লার বুলবুল আহম্মদ, নরসিংদীর আপেল ফুয়াদ, রফিক মেহেদী, জহিরুল হক, জসিম উদ্দিন, আরজিনা, হাছান, রাকিবুল হাসান, সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী, আবু তাহছির আল বাঙ্গালী হাসান, আশফাকুর রহমান, আবু মাহির, তিতুস, বাবলু রহমান, তাজুল ইসলাম সুমন, মঞ্জুরুল মুরাদ, আল রায়হী মুরাদ, শরফুল আওয়াল, শফিকুল ইসলাম শেখ, মনিরুজ্জামান প্রমুখ।
এ ব্যাপারে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, দুর্ধর্ষ জঙ্গি জাবেদ ইকবালের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে ১৯টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে ১৬টি মামলায় সাজা হয়েছে। তিনটি মামলা এখনও বিচারাধীন। আরেক জঙ্গি শামীম হোসেন গালিবের বিরুদ্ধে কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, রাজশাহীতে ৮টি মামলা আছে। ২টি মামলা এখনও বিচারাধীন। বাকি ৬টি মামলায় তার সাজা হয়েছে। মেহেদী আলমের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা আছে। এখনও তিনটি মামলার তদন্ত চলছে। জহিরুল হকের বিরুদ্ধে থাকা ৭টি মামলার মধ্যে ৫টি মামলার তদন্ত চলছে। হাছানের বিরুদ্ধে থাকা ৮টি মামলার মধ্যে ৭টি তদন্ত চলছে। বাবলু রহমানের বিরুদ্ধে আছে ৫টি মামলা। তার মধ্যে ৩টি মামলার তদন্ত চলছে। আমিনুল ইসলাম হামজার বিরুদ্ধে আছে ২টি মামলা, সেগুলোর এখনও চার্জশীট হয়নি।
তিনি জানান, আমরা চেষ্টা করছি যেসব মামলার চার্জশীট এখনও হয়নি সেগুলোর দ্রুত দেয়ার। এই জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের নিয়ে আমরা সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকি তা সত্য। কারা কর্তৃপক্ষও এই নিয়ে বেশ সতর্ক। আদালতে আনা নেয়ার সময় জঙ্গিরা নানা সমস্যা করে। বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের অবহিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কারাগারের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারী অর্থের বিনিময়ে দুর্র্ধষ জঙ্গিদের সুযোগ সুবিধা দেন। এতে জঙ্গিরা আশকারা পেয়ে কারা অভ্যন্তরে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে।
গত ১১ আগষ্ট কুষ্টিয়ায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক মীর সানাউর রহমানকে কুপিয়ে হত্যার দায়ে চার জেএমবি সদস্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এদিন দুপুরে কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ তাজুল ইসলাম এ রায় দেন।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা জঙ্গিরা হচ্ছে, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খাজানগর পূর্বপাড়ার রহমান ব্যাপারীর ছেলে আজিমুল ইসলাম, একই উপজেলার খাজানগর মাদ্রাসাপাড়ার আজিজুল হক খানের ছেলে সাইফুল ইসলাম খান, কবুরহাট এলাকার আব্দুস সামাদ সরদারের ছেলে জয়নাল সরদার ও দৌলতপুর উপজেলার পূর্ব রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে সাইফুদ্দিন কাজী। পরে তাদের পুলিশ পাহারায় জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
এরা কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের দুর্ধর্ষ জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত। এরা ২০১৬ সালের ২০ মে সকালে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল শিশিরের মাঠের নুমাগাড়ার মোড়ে পৌঁছালে সানাউর রহমানকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহতের ভাই মীর আনিছুর রহমান তাদের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করেন।
এ ব্যাপারে এডিশনাল আইজি প্রিজন কর্নেল আবরার হোসেনের মোবাইলে তিন দফা যোগাযোগ করা হলে দুই দফা মোবাইল ধরে বলেন, এখন ব্যস্ত আছি। এরপর লাইন কেটে দেন। এরপর থেকে মোবাইলটি আর তিনি রিসিভ করেননি।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, দেশে জঙ্গির সংখ্যা ৫ হাজার ৩০১ জন। গত ২৭ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩৫২টি মামলা হয়েছে। মূলত ওইসব মামলার আসামি থেকে এই তালিকা করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে ৫ হাজারের ওপরে গ্রেফতার হয়েছে। এসব আসামির মধ্যে জামিনে আছে ২ হাজার ৫১২। জেলহাজতে রয়েছে ১ হাজার ৭১৬ জন।
চলতি বছর ৭৫টি মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ২০০ জন। যাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ১৪০ জন। এর মধ্যে এক জঙ্গি জামিনে বের হয়েছে। জেলা হাজতে ১৩৯ জন ও পলাতক আছে ৬১ জন। অর্ধ শতাধিক জঙ্গির বিরুদ্ধে চার্জশীট জমা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯৪ সাল থেকে গত বছরের ৩০ আগষ্ট পর্যন্ত জঙ্গি মামলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৩৫২টি জঙ্গি মামলার মধ্যে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে ১ হাজার ২৬টি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে ৪৩টির। ২৭৩টি তদন্তাধীন মামলা রয়েছে। যেসব মামলার অভিযোগপত্র হয়েছে সেগুলোতে ৪ হাজার ৬৩৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এসব আসামির মধ্যে বিচারে ৫১ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। আর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে ৫২৮ জনকে। খালাসপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৫৯৭ জন। বিগত ২৭ বছরের জঙ্গি মামলাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ২০০৫ সালে ২০১টি মামলা হয়েছে। এরপর সর্বাধিক ১৮৪টি মামলা হয়েছে ২০১৬ সালে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ১২২টি ও ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ১০৩টি।
সারাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে সফল পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। এটিইউয়ের পুলিশ সুপার (মিডিয়া এ্যান্ড এ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের সব মামলায় দ্রুত চার্জশীট দেয়া হয়। আমাদের আগে কেউ এত দ্রুত চার্জশীট দিতে পারে না। যাতে করে জঙ্গিদের দ্রুত সাজা হয়ে যায়। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান জানান, ২০১৯ সালে এটিইউ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ১১০টি অভিযানে প্রায় ২শত জঙ্গি গ্রেফতার করেছে। এ পর্যন্ত ৬৭টি মামলার মধ্যে ২৭টি চার্জশীট দেয়া হয়েছে। ৪০টি এখনও তদন্তাধীন।
সেগুলোতে শীঘ্রই চার্জশীট দেয়া হবে। কয়েকটি মামলায় কয়েক জঙ্গির সাজা হয়েছে। তিনি জানান, ২০১৯ সালে ২৭ জন, ২০২০ সালে ৬৩ জন, ২০২১ সালে ৫৬ জন এবং চলতি বছরের ১০ আগস্ট পর্যন্ত ৩৫ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের অধিকাংশ মামলার চার্জশীট দেয়া হয়েছে। অনেক মামলার রায়ও হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, গ্রেফতার জঙ্গিদের সবার মামলায় যত দ্রুত সম্ভব চার্জশীট দেয়া হয়। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬১৪ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৯২ মামলা হয়েছে। এসব মামলা ৬০৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪৪ জঙ্গির বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হয়েছে।
সিটিটিসির ইনভেস্টিগেশন, এসএজি ও ইন্টেলিজেন্স বিভাগের এডিসি জাহিদ জানান, এ পর্যন্ত তিনটি মামলার ১৮ জনের মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। ১ জনকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে। ৮৫টি তদন্তাধীন মামলা রয়েছে। অচিরেই সেগুলোর চার্জশীট দেয়া হবে। তিনি জানান, মোস্ট ওয়ান্টেড পলাতক জঙ্গি চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, মেহেদী হাসান জন, সালাউদ্দিন সালেহীন। তাদের গ্রেফতারের জন্য একের পর এক অভিযান চলছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত আড়াই হাজার জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে। শুধু হলি আর্টিজান হামলার পরে এখন পর্যন্ত ১৬শ’র বেশি জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ৮৬৪ জন জেএমবি সদস্য, ৪০৬ জন আনসার আল ইসলামের সদস্য, আল্লাহর দলের ২০১ জন, হিযবুত তাহরীর ৮৮ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৮৬ ও হুজির ৩০ সদস্য রয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশী-বিদেশী ৬৫টি অস্ত্র, ২৫২ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১০২টি গ্রেনেড ও ককটেল, ৮০টি ডেটোনেটর ও সাড়ে ১৬ কেজি বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক জব্দ করা হয়।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় কারাগারে ডির্যাডিকালাইজেশন কর্মসূচী রয়েছে। এছাড়া পুলিশ, র্যাব, সিটিটিসি ও এটিইউ বিভিন্ন সময় ডির্যাডিকালাইজেশনে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। নানামুখী অভিযানে জঙ্গিদের সামর্থ্য নষ্ট করা সম্ভব। কিন্তু তাদের আদর্শ থাকে ব্রেনে। কারও ভেতর ভুল মতাদর্শ থাকলে সেটা শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। সেটার জন্য বিভিন্ন ‘মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় ফিল্মি স্টাইলে ট্রাক দিয়ে চলন্ত প্রিজন ভ্যান থামিয়ে, বোমা মেরে, গুলি চালিয়ে পুলিশ সদস্যদের হতাহত করে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এদিন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিদের দুটি মামলায় হাজিরার জন্য ময়মনসিংহ আদালতে নেয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে।
জঙ্গি বাহিনীর হামলায় প্রিজন ভ্যানের পাহারায় থাকা চার পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। তিনজন গুরুতর আহত হন। ছিনিয়ে নেয়া ভয়ংকর দুর্র্ধষ জঙ্গিরা হচ্ছে, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সজীব ওরফে তাওহীদ (৩৮), হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাশেদ ওরফে রাকিব হাসান (৩৫) ও জাহিদুল ইসলাম সুমন ওরফে বোমা মিজান (৩৫)। জেএমবির শূরা সদস্য সালাউদ্দিন সালেহীন তিনটি মামলার রায়ে ফাঁসির দণ্ড এবং ১০টি মামলার রায়ে ১৮০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। আরও ২৯টি মামলা বিচারাধীন। রাকিবুল হাসানের একটি মামলায় ফাঁসি ও তিন মামলায় ৬৫ বছরের সাজা রয়েছে।
বোমা মিজানের যাবজ্জীবনসহ পাঁচ মামলায় ৯০ বছরের সাজার দণ্ড রয়েছে। সে জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা। পরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের গ্রেফতার করে। পরে তাদের সাজা কার্যকর হয়। এরপর থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নড়েচড়ে বসে। কারা কর্তৃপক্ষ কঠোর পাহারায় জঙ্গিদের আদালতে আনা নেয়ার ব্যবস্থা করে।