বিদায় অকৃত্রিম বন্ধুকে

8

জাপানের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিই ছিলেন জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর শাসনামলে জাপানে যেমন অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও জাপান এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে। তাঁর নেতৃত্বে জাপানের প্রাচ্যনীতি অনেক শক্তিশালী হয়েছে।
এ সময় বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক সর্বোচ্চ সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছায়। ঢাকায় মেট্রো রেল, কক্সবাজারে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ হাব ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সংগত কারণেই প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
জাপানে সন্ত্রাসী ঘটনা খুবই বিরল। ব্যক্তিগত বন্দুক সংগ্রহে রয়েছে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি। তা সত্ত্বেও গত শুক্রবার জাপানেরই একটি শহরে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আবে ওই সময় জাপানের নারা শহরে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) এক নির্বাচনী সভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন। পর পর দুটি গুলি তাঁকে বিদীর্ণ করে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুধু জাপান নয়, সারা বিশ্বকে শোকস্তব্ধ করে দেয়। পৃথিবীর প্রায় সব বড় নেতা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের জন্ম ১৯৫৪ সালে এক সম্ভ্রন্ত রাজনৈতিক পরিবারে। তাঁর বাবা শিনতারো আবে একসময় জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। একসময়ের প্রধানমন্ত্রী নোবুসুকে কিশির দৌহিত্র শিনজো আবে পড়াশোনা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে। ঐতিহ্য ও শিক্ষার মিলিত প্রভাব লক্ষ করা যায় তাঁর রাজনীতিতে। তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ২০০৬ সালে। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে বছরখানেক পরই তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁর অবর্তমানে ১৯৫৫ সালের পর দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালে এলডিপি ক্ষমতা হারায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ২০১২ সালে দলকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এরপর ২০২০ সালের আগষ্ট পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় থেকে তিনি রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এই সময়ে তিনি দেশে ও বিদেশে জাপানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেন, যাকে ‘আবেনোমিকস’ হিসেবে উরেখ করা হয়। তিনি জাপানের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জাপানের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য সংবিধান সংশোধনেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার পাশাপাশি পাশ্চাত্যবিরোধী শিবিরের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তিনি ১৭ বার সাক্ষাৎ করেছেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে চেষ্টা করে গেছেন।
শিনজো আবের মৃত্যু শুধু জাপান নয়, সারা বিশ্বের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর মৃত্যুতে গণতন্ত্র, মানবতা বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। আমরা আশা করি তাঁর হত্যাকাণ্ডের পেছনের সব রহস্য সঠিক সময়ে উদঘাটিত হবে।