পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণের পর্যটন শিল্পে সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পদ্মা সেতু ঘিরে প্রসার ঘটছে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের। সবার শীর্ষে রয়েছে- ট্যুরিজম। পদ্মার এপার ওপার-উভয় পাড়েই গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র। ইতোমধ্যে ঢিমেতালে চলা প্রতিষ্ঠিত সরকারী-বেসরকারী পর্যটনকেন্দ্রগুলোও ফিরে পেয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। নব উদ্যমে সাজানো হচ্ছে সব। পুরনো ও নতুন মিলিয়ে পর্যটন শিল্প বিকাশে ধুম লেগেছে। পর্যটনকে চাঙ্গা করতে পরিবহন খাতেও নেয়া হয়েছে ব্যাপক কার্যক্রম। বিআরটিসি ইতোমধ্যেই পদ্মার ওপারে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ রুটে বাস চালুর ঘোষণা দিয়েছে। বিলাসবহুল বাস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে দেশের শীর্ষ পরিবহন কোম্পানিগুলো। পদ্মা পেরিয়ে মাত্র চার ঘণ্টায় কুয়াকাটাসহ অন্যান্য স্পটে পৌঁছে দেয়ার প্যাকেজ ঘোষণার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এসব পদক্ষেপে চলতি বর্ষাতেই পদ্মার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেবে। এ ছাড়া এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে শীর্ষ পর্যটনকেন্দ্রগুলোর আসন বুকিং। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পদ্মার ঢেউয়ের তালে তালেই এবার গর্জে উঠবে ঝিমিয়ে পড়া পর্যটনকেন্দ্রগুলো। এখনই বুকিং দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পবিত্র ঈদুল আযহার আগে-পরের এক সপ্তাহ কোন সিট খালি নেই শীর্ষ মোটেলগুলোতে। এ অবস্থা আরও ক’দিন চলতে পারে।
অন্যদিকে, বেসরকারী ট্যুর অপারেটর এ্যাসোসিয়েশন টোয়াবের সাবেক সভাপতি রাফিউজ্জামান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, করোনায় এ শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার অন্যতম উপায় হতে পারে পদ্মা সেতু। আগামী ২৬ জুন সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর রাতারাতি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ভ্রমণপ্রেমীদের ভিড় জমবে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। অগ্রসরমান পর্যটনকেন্দ্রগুলো এখন বেগবান হবে। যেমন সিলেট ও কক্সবাজার শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে, পদ্মা সেতুর কারণেও একই রূপ দেখা যাবে দক্ষিণাঞ্চলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুয়াকাটা, পায়রা, ভোমরা ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশ্বনন্দিত সুন্দরবনসহ দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্পে অবারিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর কল্যাণে সুন্দরবনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় কুয়াকাটা ও সুন্দরবন নতুন গতি পাবে। এখন এই সম্ভাবনাকে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই অর্থনৈতিক ছন্দ ফিরে আসবে।
জানা গেছে, বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে নতুন রূপে সাজছে দক্ষিণের সাগরকন্যা কুয়াকাটা। এই সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটায় পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা। এর ফলে ব্যাপক পর্যটক সমাগমের আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিষয়টি মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক মানের খাবার ব্যবস্থাসহ নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে হোটেল- মোটেল।
এদিকে, ঢালাওভাবে যদি সব উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তাহলে সেটা পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো আশঙ্কা থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন বিশ্ব হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই খেয়াল রাখতে হবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য অধিক পর্যটকের কারণে যেন নষ্ট না হয়। পাশাপাশি যথাযথ পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অবকাঠামোগত ও আইনগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এটা বনাবিভাগের দায়িত্ব। সে জন্য ইকো ট্যুরিজমের দিকে অগ্রসর হতে হবে। বিশেষ করে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল যে সব জনগোষ্ঠী রয়েছে তারা উপকৃত হবে এবং ইকো ট্যুরিজমেও তারা অংশ নিতে পারবে।
রাফিউজ্জামান বলেন, আমরা উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি- যখন কক্সবাজারের কথা চিন্তা করি। প্রতিবছর বিভিন্ন সময় সেখানে পর্যটকের ঢল নামে। সেই অর্থে আমাদের সুন্দরবনের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে, যা দেখে বিশ্ব আকৃষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতু যেভাবে দক্ষিণাঞ্চলকে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, ঠিক সেভাবে আমাদের মনোবলকে অনেক দৃঢ় করেছে। তিনি বলেন, এই দক্ষিণাঞ্চল দীর্ঘদিন রাজধানী ঢাকা থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। আগে ঢাকায় যেতে দক্ষিণাঞ্চলের লোকদের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। সেটা এখন মাত্র ৪ ঘণ্টায় সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি এ অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের অতি সহজে যথাযথ মূল্য পাওয়া যাবে। কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, পদ্মার দুপাড়েই পর্যটন চাঙ্গা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য পছন্দের স্পটে পরিণত হতে পারে স্বয়ং পদ্মা সেতু। একই সঙ্গে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের সব পর্যটন স্পট জনপ্রিয় হবে আগের চেয়ে। কাজেই সব কিছু মিলিয়ে ঢাকা থেকে বেরিয়ে পদ্মা পেরিয়ে যে দিকেই যাবেন সেখানেই পাবেন পর্যটনের পরিবেশ।
এদিকে, সরজমিনে দেখা যায়, উদ্বোধনের আগেই এখন প্রতিমুহূর্তে পদ্মাপাড়ে চলছে অগণিত মানুষের ভিড়। স্বপ্নের এই সেতু চালুর আগেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য মানুষ। সেতুর আশপাশে নৌ-যানে চড়ে কাছ থেকে দেখছেন স্বপ্নের সেতু। স্মৃতি হিসেবে সেতুর সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা গেছে অনেককে। হাসনাইন নামের এক যুবক জানান, পদ্মা সেতু অনেক আলোচিত এবং সরকারের মেগা প্রজেক্ট। দৃষ্টিনন্দন এই সেতু দেখার আগ্রহ ছিল অনেক। তাই উদ্বোধনের আগে একবার দেখতে এলাম। তিনি বলেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই সেতু কাছ থেকে দেখার অনুভূতি অন্য রকম। দেশী-বিদেশী যে কাউকে এ দৃশ্য মুগ্ধ করবে। এক দিকে রেল-বাসের ঝনঝনানি, অন্যদিকে নদীর ঢেউয়ের কলতান নতুন এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করবে।
সরজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, পদ্মার দু’পাড়েই গড়ে উঠছে নানাবিধ স্থাপনা। উভয় প্রান্তেই গড়ে উঠছে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠান। পরিদর্শনে দেখা যায়, জাজিরার নাওডোবা থেকে শিবচরের মাদবর চর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সাড়ে ১০ কিলোমিটার নদীশাসন এলাকাও এখন দৃষ্টিনন্দন বিনোদনকেন্দ্র। প্রতিদিন বহু মানুষ ওই এলাকা ঘুরে দেখেন। পুরনো দর্শনীয় স্থানগুলোও পদ্মা সেতু ঘিরে আরও জমজমাট হয়েছে। শরীয়তপুরের নড়িয়ায় যেমন আছে রামঠাকুরের আশ্রম। এ ছাড়া ভেদরগঞ্জে মহিসার দ্বিগম্বরের দীঘি, হাটুরিয়া জমিদারবাড়ি, মানসিংহের দুর্গসহ নানা দর্শনীয় স্থাপনা এখানে রয়েছে। তারপর রয়েছে- সুন্দরবন, বাগেরহাট ও কুয়াকাটার নৈসর্গিক দৃশ্যের হাতছানি। পদ্মার সংযোগ সেতুর পাশে ‘রোজ ভিউ’ নামে প্রকৃতিবান্ধব একটি রেস্তরোঁ গড়ে তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হাসান বিন ইসলাম সজিব। পর্যটকদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আশপাশে আরও রেস্তরাঁ ও রিসোর্ট গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে তার। তিনি বলেন, আমি ট্যুরিজমে পড়েছি, আমি জানি এখানে পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার দারুণ সম্ভাবনা আছে। একটি রেস্তরাঁ ইতোমধ্যে চালু করেছি, ভাল সাড়া পাচ্ছি। আগামীতে সুন্দর একটি রিসোর্ট করার পরিকল্পনা আছে।
টোয়াবের বর্তমান সভাপতি শিবলুল আজিম কোরেশী বলেন, এই একটি সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মার ওই পাড়ে পর্যটনের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে যে তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রয়েছে তার দুটিই দক্ষিণাঞ্চলে- ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন। এই জায়গাগুলো মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এতদিন পর্যটকের সংখ্যা কম ছিল। সাগরকন্যা কুয়াকাটা, যেখান থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখা যায়, ঢাকা থেকে সেখানে যেতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে অনেক পর্যটক যেত না। এবার এখানেও পর্যটক বাড়বে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় আরও অনেক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোতে পর্যটকরা যেতে আগ্রহ দেখাবে এবং পদ্মা সেতুকেকেন্দ্র করে নতুন নতুন পর্যটন স্পট তৈরি হবে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ওই অঞ্চলের মানুষরা উপকৃত হবে। স্বল্পকালীন থাকার ব্যবস্থা রেখে অধিকাংশ হোটেল বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি আবাসিক হোটেলগুলোতে ৫০ এবং খাবার হোটেলে ৩০ ভাগ ভাড়া ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ইলিশ বাড়ি নামের একটি রেস্টুরেন্ট মালিক জানান, জাজিরা ছিল চিরঅবহেলিত। এখন সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ঘটবে। তখন আর এই এলাকা অবহেলিত থাকবে না। এখানে পর্যটনকেন্দ্র, ইপিজেডসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা হবে, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, হোটেল-মোটেল হবে। ইতোমধ্যে তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এভাবেই পাল্টে যাবে জাজিরা।
হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু পর্যটনের নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এই সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে ভোরে যাত্রা করে দুপুরের আগেই কুয়াকাটা পৌঁছানো যাবে। এরপর দিনভর আনন্দ-উল্লাস করে শেষ বিকেলে সূর্যোদয় দেখে রাতে আবার ঢাকায় ফিরতে পারবেন পর্যটকরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাগরকন্যা কুয়াকাটার সবচেয়ে বড় সিকদার রিসোর্ট এ্যান্ড ভিলাসের মহাব্যবস্থাপক আল আমিন বলেন, এটা অবশ্যই শুভ দিনের আগমনী বলা চলে। আমরা দেশী-বিদেশী পর্যটক আকৃষ্ট করতে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করেছি। হোটেলে আবাসন সিটের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকদের জন্য আমরা নতুন নতুন ভিউ তৈরি করেছি। ‘ইতোমধ্যে ২৫ তারিখের পরের কয়েক দিনের জন্য অগ্রিম বুকিংয়ের ব্যাপারে অনেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে প্রতিদিনই পর্যটকরা জানতে চাইছেন। সিকদার রিসোর্টে বিদেশী পর্যটকদের খাবার পরিবেশনের জন্য প্রখ্যাত শেফ জুলফিকার মোঃ জাহিদি ওরফে শেফ জাহিদিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করি, পর্যটকরা আমাদের খাবার পরিবেশনে খুশি হবেন।
অপর একটি রিসোর্ট মালিক হাসান জানান, বিভিন্ন হোটেলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য উন্নতমানের খাবার পরিবেশনসহ বিভিন্ন সেবা দিতে দক্ষ জনবলও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। পর্যটন বিকাশে পটুয়াখালী জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন মৃধা সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, এরই মধ্যে উন্নতমানের বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এই রুটে তারা গাড়ি চালাতে চায়। তারা এলে বদলে যাবে পর্যটন খাতের চিত্র।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ট্যুরিস্ট পুলিশ আগের চেয়ে আরও তৎপর হয়েছে। পর্যটকদের বাড়তি নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভ্রাম্যমান টিমসহ একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।