কাজিরবাজার ডেস্ক :
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনর্মহাবিপ্লব হেতু/এই ¯্র্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু…। বড্ড পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।’ প্রেম দ্রোহের দ্বৈতসত্তায় নিজেকে গড়েছিলেন। সাম্যের মানবের এবং মানবতার কবি ‘অপমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ বুকে ধারণ করেছিলেন। সারাজীবন ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলা ‘দুখু মিয়া’ তিনি। তিনি কবি, কান্ডারি কাজী নজরুল ইসলাম।
আজ ১১ জৈষ্ঠ্য বুধবার ‘ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ’র ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। করোনার কারণে গত দুই বছর দিবসটি সেভাবে উদ্যাপন করা না গেলেও, এবার বিপুল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ সারাদেশে উদ্যাপিত হবে নজরুল জয়ন্তী। এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কাজী নজরুল ইসলাম চির বিদ্রোহী বীর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনদিন আপোস করেননি। শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম হাতে যে প্রতিবাদ গড়েছিলেন কবি, আজও তা ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কবির গান কবিতা বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। নজরুলের কবিতা সাম্যের কথা বলে। মানবতার কথা বলে। ধর্ম ও জাত পাতের নিকুচি করেছেন কবি। ধর্মের নামে অধর্ম, জাতের নামে বজ্জাতির শ্রেষ্ঠতম প্রতিবাদ তাঁর কবিতা ও গান। কবি ‘মানুষ’ পরিচয়টিকে রেখেছেন সবকিছুর ওপরে। তাঁর ভাষায় ঃ ‘জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহনশীল,/ তাকে কি ভাই ভাঙ্গতে পারে ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।/যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত,/ আজ নয় কাল ভাঙ্গবে সে ত,/ যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া…।’ মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়া কবি ছিলেন নারীর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল। কবিতায় আমরা সে প্রমাণ পাই, তিনি সেখানে লিখেছেন, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
কাজী নজরুল ইসলামের নিজের জীবনও ছিল বর্ণাঢ্য। ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছেন। জন্মগ্রহণ করেছিলেন অতিদরিদ্র পরিবারে। মক্তবে পড়ালেখা দিয়ে শিক্ষা জীবনের শুরু। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে এমনকি রুটির দোকানে কাজ করেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতিও।
সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তুলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি লিখেছিলেন, …আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল…। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈ চৈ ফেলে দেয় সর্বত্র।
কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনা নিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’
তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভান্ডার রেখে গেছেন কবি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়।
তবে জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল নানা লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল)। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
রাষ্ট্রপতির বাণী : নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। কবির ক্ষুরধার অগ্নিঝরা লেখনী শোষিত নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার করে। শিক্ষা দেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। নতুন প্রজন্ম নজরুলের কর্ম চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলা সাহিত্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক অবস্মরণীয় নাম। তাঁর শিকল ভাঙ্গার গানে জেগে উঠেছিল ঝিমিয়ে পড়া বাঙালী সমাজ। সাম্য, মানবতা, তারুণ্য ও দ্রোহের কবি তিনি। নজরুল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকার কাজ করছে বলেও বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশনা : ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিবসটি স্মরণে কবির জন্মদিনের একদিন আগে মঙ্গলবার ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখরসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ডাক অধিদফতর ১০ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকেট, ১০ টাকা মূল্যমানের একটি উদ্বোধনী খাম, ৫ টাকা মূল্যমানের একটি ডাটাকার্ড ও একটি বিশেষ সীলমোহর প্রকাশ করে। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানেই এসব স্মারক ডাকটিকেট ও উদ্বোধনী খাম অবমুক্ত করেন এবং ডাটা কার্ড ও বিশেষ সীলমোহর প্রকাশ করেন।
স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ : নজরুলকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বরণের সুবর্ণজয়ন্তীর দিন ২৪শে মে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে ‘বিদ্রোহী : শতবর্ষে শতদৃষ্টি’ শীর্ষক সাত শতাধিক পৃষ্ঠার স্মারকগ্রন্থ। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ রচনার পটভূমি-ইতিহাস, সমকালীন সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি-বিশ্বপরিস্থিতি, বাংলা কবিতা-সাহিত্যে ও সমাজে ‘বিদ্রোহী’র সমকালীন এবং উত্তরপ্রভাব, বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী অন্যান্য কবিতার সঙ্গে ‘বিদ্রোহী’র তুলনামূলক আলোচনাসহ এ সংক্রান্ত নানা বিষয়ে এক শজন নবীন-প্রবীণ লেখকের একটি নতুন লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বইতে।
নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা : জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লায়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, টাউন হলে সকাল ১১টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন তথ্য ও সম্প্রারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি। স্মারক বক্তৃতা করবেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনায় নৃত্যনাট্যসহ থাকবে ৩০ মিনিটের বিশেষ পরিবেশনা।
নজরুলের আরেকটি খুব উল্লেখযোগ্য স্মৃতিবিজড়িত স্থান ময়মনসিংহ। আজ থেকে জেলার ত্রিশালে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। অন্যান্য আয়োজনের পাশাপাশি দরিরামপুর সরকারী নজরুল একাডেমি মাঠে চলবে তিন দিনের নজরুল মেলা।