কাজিরবাজার ডেস্ক :
দিনদিন আরও অনিরাপদ হয়ে উঠছে সাইবার জগত। ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি, ইমো হ্যাকের পর ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায়, ধর্ষণ এবং এর ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার মতো সাইবার অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য জালিয়াতি করে জাল সনদ তৈরি, গুরুত্বপূর্ণ ও ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, স্কাইপে ভুয়া আইডি খুলে জালিয়াতি ও প্রতারণা, বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, আইডি হ্যাক, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অনলাইনে জুয়া খেলাসহ অন্তত ১৩ ধরনের সাইবার অপরাধ ঘটছে। আইনে কড়াকড়ি আরোপ করাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও এমন অপরাধ কমছে না। সাইবার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রতিদিনই অভিযোগ জমা পড়ছে।
সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তা ও সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর-তরুণরা সাইবার অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। আর এর শিকার হচ্ছে মেয়েরা। অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার মতো বিভিন্ন কারণে হতাশ হয়ে সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। এ্যাপস বন্ধ করে সাইবার অপরাধ ঠেকানো সম্ভব নয়। এর জন্য পুলিশের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে তো বিরত থাকা যাবে না। তবে প্রযুক্তির অপব্যবহার যেন না হয় সেটা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। সাইবার অপরাধ থেকে রক্ষা পেতে অপরিচিত কাউকে বন্ধু না বানানো, অপরিচিত বা সন্দেহজনক লিংকে প্রবেশ না করা, কারও সঙ্গে পাসওয়ার্ড শেয়ার না করা এবং সচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর পরও কেউ অপরাধের শিকার হলে দ্রুত থানা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে প্রমাণসহ জানাতে হবে।
শুধু আইডি হ্যাক করে কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করেই নয়; ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে তথা পুলিশের আইজি পরিচয়ে, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) পরিচয়ে প্রতারণা, নারী পুলিশের আপত্তিকর ছবি ছড়ানো, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা, গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে অপরাধীরা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা হয়রানি ও সম্মানের কথা ভেবে এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে না। সাইবার অপরাধ দমনে সরকার জোরালোভাবে কার্যক্রম শুরু করলেও বিচার ও শাস্তির হার খুবই কম। যার কারণে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন না। এ ছাড়া স্বচ্ছ ধারণা না থাকা ও প্রতিকার পেতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা বেশি।
গত ১১ এপ্রিল আশুলিয়ায় বসে ফিশিং লিংকের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী নাগরিকদের প্রায় ২ হাজার ৫০০ ফেসবুক আইডি হ্যাক করার অভিযোগে মোঃ লিটন ইসলাম নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে ডিবির-সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া লিটন হ্যাক করা আইডি থেকে গুরুত্বপূর্ণ-স্পর্শকাতর তথ্য, গোপন ছবি এবং ভিডিও হাতিয়ে নিত। তাদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেল করে অর্থ হাতিয়ে নিতো। এমনই এক ভুক্তভোগী কদমতলী থানায় গত ২৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক হ্যাকার লিটন ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে তদন্ত করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় বিভিন্ন ডিভাইসে তার দখলে থাকা ২ হাজার ৫০০ দেশী-বিদেশী ফেসবুক আইডির ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড পাওয়া যায়।
অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের লিডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ নাজমুল হক বলেন, লিটন ভুক্তভোগীদের বলত ‘টাকা না দিলে আপনার আইডি থেকে রাষ্ট্রবিরোধী এমন পোস্ট করা হবে যেন সবাই আপনাকে জঙ্গী মনে করেন। এসব হুমকি দেয়ার পর ভুক্তভোগীরা ভয়ে তাকে টাকা দিয়ে দিত। যাদের মধ্যে অনেক ভিআইপি ও শিল্পপতিদেরও এ্যাকাউন্ট আছে। শুধু দেশের নয় বিদেশী নাগরিকদের আইডিও সে হ্যাক করেছে। তবে বেশি ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়েছে মেয়েরা।
সাইবার অপরাধের মামলা তদন্ত ও ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর-তরুণরা বেশি সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ বিপদগ্রস্ত হয়ে, কেউ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিংবা বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের আড্ডায় পড়ে এই জগতে প্রবেশ করছে। কাউকে ঘায়েল করতে তার নামে ভুয়া আইডি খুলে কুরুচিপূর্ণ নানা পোস্ট দিচ্ছে।
তরুণদের সাইবার জগতের এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে ফেরত আনতে অনলাইনকেন্দ্রিক অপরাধমূলক কর্মকা- প্রতিরোধে বিভিন্ন এ্যাপস বন্ধের প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে। তবে তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা মনে করেন, এ্যাপস বন্ধ করা যেমন কঠিন তেমনি সেগুলো নিষিদ্ধ করেও লাভ নেই। নিষিদ্ধ করে ব্যবহার ঠেকানো যায় না। এর জন্য দুইটি বিষয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের সক্ষমতা আরও বাড়ানো এবং দরকার প্যারেন্টাল গাইডেন্স। সন্তান যে গ্যাজেটটি ব্যবহার করছে তার প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অন করে দিতে হবে। ফলে সন্তান যদি কোন নিষিদ্ধ এ্যাপ ব্যবহার করে, সাইটে ঢোকে বা গ্রুপে তৎপর হয় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তার নোটিফিকেশন পাবেন।
সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত নবেম্বর পর্যন্ত (এক বছরে) ১২ হাজার ৬৪১ জন নারী ভুক্তভোগী সাইবার স্পেসে হয়রানি সংক্রান্ত যোগাযোগ করেছেন এই সেলে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। এর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তে পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে হয়রানি সংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে আট হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
তথ্যানুযায়ী, ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ৪৭৫ জন। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করা হয়েছে এক হাজার ৮৮৪ জন নারীকে, আর আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির করা হয় ৯৯২ জনকে। অন্যান্য উপায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন এক হাজার ৫১৮ জন। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে বিভিন্ন বয়সী নারী ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। তবে অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কম বয়সী। শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি।
এছাড়া সিআইডি, ডিএমপির সাইবার সেন্টারে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দিনকে দিন বাড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা গেছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি আইন, আইসিটি আইন, টেলিকমিউনিকেশন আইনে সারাদেশে ২০১৫ সালে যেখানে ৬৩৮টি মামলা হয়েছে, সেখানে ২০২০ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৫৯টিতে।
ডিএমপির সিটিসাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ১৮ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৭ শতাংশ, ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ৫৫ থেকে বেশি বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে ৩ শতাংশ তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপরাধে জড়াচ্ছে।
সিটিটিসি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের তথ্যমতে, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪০টি মৌখিক ও লিখিত সাইবার সম্পর্কিত অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে ব্ল্যাকমেলিং, মোবাইল ব্যাকিং ও পর্নোগ্রাফির অভিযোগ বেশি।
তবে পরিকল্পিত সাইবার অপরাধের মামলা এখনও অনেক কম। গত সাত বছরে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আসা মামলার মাত্র ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ হ্যাকিং, কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তনের মতো গুরুতর অভিযোগে করা। এর মধ্যে হ্যাকিংয়ের মামলাগুলোর বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক হ্যাকিংয়ের অভিযোগে করা হয়। এ ছাড়া বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। এর বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের অভিযোগের মামলাও এসেছে ট্রাইব্যুনালে।
ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের দৈনন্দিন কার্যতালিকাসহ মামলার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য মামলা এসেছে ২ হাজার ৬৬৯টি। এর মধ্যে হ্যাকিং, কম্পিউটার সিস্টেম নষ্ট, কম্পিউটার সোর্স কোড পরিবর্তন, সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা মাত্র ১১৩। এটা মোট মামলার ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাইবার অপরাধের মামলা বেশি হচ্ছে মূলত অনলাইনে মানহানি, মিথ্যা তথ্য, অশ্লীল ছবি ও তথ্য প্রকাশের অভিযোগে। সে তুলনায় হ্যাকিংসহ অন্য গুরুতর অপরাধের মামলা কম, সাজাও নগণ্য।
বিটিআরসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটিআরসি শুধু ইউটিউব, ফেসবুকের কোন কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করতে পারে। সেই কনটেন্ট তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড পরিপন্থী হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তা অপসারণ করে, নয়তো করে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বা সরকারের পক্ষে ইন্টারনেট জগতে কোন কিছু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।