বিএনপি ‘না’ করে দিয়েছে জামায়াতকে

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে বিএনপি। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে সমমনা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘যুগপৎ’ কর্মসূচির দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। বিএনপি, জামায়াত ও যুগপৎ-এ আগ্রহী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে কোনও কর্মসূচি পালন করা হবে না। এ কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘ ২২ বছরের জোটসঙ্গী জামায়াতকেও। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের এক নেতা দলের সিদ্ধান্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, যে তারা জোটবদ্ধভাবে আর কোনও কর্মসূচি পালন করবেন না।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, জোটবদ্ধভাবে কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের। এই সিদ্ধান্ত জামায়াতকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় ‘অনাপত্তি’ দিয়েছে জামায়াত।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এখনই এ বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি। আমরা সবার সঙ্গে সামগ্রিকভাবে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত জানাবো।’
জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা জানিয়েছেন, ‘২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়েছে এমন কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। জোট রান করবে না, এমনটিও বিএনপির তরফে বলা হয়নি। তবে, যার-যার অবস্থান থেকে সরকার পতনের আন্দোলনের প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে উভয় দল একমত হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘বিষয়টা আনুষ্ঠানিক কিছু নয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতার জন্য কৌশলগত কারণে যেটা উত্তম সেটাই করবে জামায়াত। সেক্ষেত্রে যদি জোট সম্প্রসারিত হয় বা নিজ-নিজ প্ল্যাটফর্মে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনও হয়, তাতে আপত্তি নেই।’
ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এক দফার আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বর্তমান সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও অবাধ নির্বাচন। এই দাবি আদায়ে সফলতার জন্য কৌশলগতভাবে যেটা উত্তম জোটগত বা যুগপৎ বা আরও সম্প্রসারণ, সেইসব কৌশলের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কৌশলগত কারণে যেভাবেই আন্দোলন হোক, ২০ দলীয় জোটের পারস্পরিক সিদ্ধান্ত ও সকলের সম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’
বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতার ভাষ্য, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাসহ নানা কারণে বিতর্কিত জামায়াত। দলটির সঙ্গে বিগত প্রায় তিন বছর ধরেই প্রকাশ্যে কোনও আয়োজনে নেই বিএনপি। সম্প্রতি প্রেসক্লাবের সামনে অনশনে জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল অংশগ্রহণ করার পর দলের শীর্ষপর্যায়ে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। নেতাদের কারও সন্দেহ, সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন, এমন কোনও নেতা বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই জামায়াতকে প্রকাশ্যে ঠেলে দিচ্ছে কর্মসূচিতে।
যদিও জামায়াতের প্রভাবশালী এক নেতা এসব বিষয়কে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে রাজি নন, বলে দাবি করেন এ প্রতিবেদকের কাছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ‘১৮ দলীয় জোটে’রূপ পায়। পর্যায়ক্রমে ২০ দলীয় জোট হিসেবে সক্রিয় ছিল।
জোট নয়, যুগপৎ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত বিরোধী দলগুলোর
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জোট সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে জোটগত কর্মসূচি না দেওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেকটি দলই যেন নিজ-নিজ দলীয় শক্তির ভিত্তিতে সরকারবিরোধী কর্মসূচি প্রণয়ন করে এ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। ইতোমধ্যে বিএনপির সিনিয়র তিন নেতা শরিকদের সঙ্গে পৃথক-পৃথকভাবে আলোচনা করে দলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই তিন নেতা স্থায়ী কমিটিতে পুরো কার্যক্রম সম্পন্ন করে অবহিত করবেন, বলেও দাবি করা হয়েছে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে।
জোটের শরিক এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল অব. অলি আহমদ বলেন, ‘প্রত্যেকে নিজ-নিজ জায়গা থেকে এবং নতুন যারা আসবে প্রত্যেকেই নিজেদের শক্তি প্রদর্শন সংগ্রাম করবে, মিটিং-মিছিল করবে এটাই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছিলো। আমরাও বলেছি এটাতে আমাদের আপত্তি নাই।’ আর জামায়াতের বিষয়ে বিএনপি কী করবে, এটা নিয়ে আমার মন্তব্য করা উচিৎ হবে না, এটা বিএনপিই ঠিক করবে, বলে মন্তব্য করেন অলি আহমদ।
এলডিপির আরেক অংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম জানিয়েছেন, বিএনপির পক্ষ থেকে জোটের শরিকদের ইতোমধ্যে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিএনপির তরফে বলা হয়েছে, অগণতান্ত্রিক সরকারকে হটাতে বৃহত্তর আন্দোলনের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যথাসময়ে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক কাতারে যুগপৎ আন্দোলনে শামিল করা হবে।’
২০ দলীয় জোটের বাইরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েকজন শীর্ষনেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে বিএনপির সঙ্গে যেসব দলগুলোর আলোচনা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই জোটহীন কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও ‘যুগপৎ’ কর্মসূচির পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত, ডান-বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোকে একমঞ্চে আনার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা রয়েছে, ‘যুগপৎ’ কর্মসূচি হলে তা থাকবে না, বলে জানিয়েছে ঐক্যে আগ্রহী দলগুলো। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালেও কয়েকজন নেতা বিষয়টি স্বীকার করেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি মনে করেন, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্যমত দরকার। ‘বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, সংবিধান সংস্কার ইস্যুতে যত দ্রুত ঐক্যমত তৈরি হবে, তত দ্রুতই জাতির জন্য মঙ্গল’’ বলে ণ্ডজানান তিনি।
বাম জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জানান, রমজানের কারণে হয়তো বিএনপির আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় শুরু হচ্ছে না। তবে যুগপৎ কর্মসূচির সম্ভাবনার বিষয়টি ইতিবাচক বলে জানান সাইফুল হক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সূত্র জানিয়েছে, যুগপৎ কর্মসূচির কৌশল ও পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে এখন কাজ চলছে। রমজানে বা সামনের মাস থেকেই এ বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসবে বলে জানায় সূত্র।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘এখন তো রমজান মাস চলছে, ‘পলিটিক্স অব ইফতার’। পারস্পরিক কথা বলা হচ্ছে, কথা বলছি। আমরা আলোচনার সূত্রপাত করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবেও শুরু হবে। আগে থেকে এ বিষয়ে আউটলাইন দিতে পারবো না।’’