রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, পাক পার্লামেন্টে উত্তেজনা ॥ ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর আলোচনা

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পাকিস্তানের রাজনীতিতে ফের অনিশ্চয়তার ঘনঘটা। পাক সুপ্রীমকোর্টের রায় অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্য নির্ধারণে শনিবার সকালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যথারীতি শুরু হলেও ক্ষমতাসীন দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) অনাস্থা প্রস্তাব বিলম্বিত করার কৌশল গ্রহণ করে। প্রতিবাদে বিরোধীরা হট্টগোল শুরু করলে পাকিস্তানের স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করেন স্পিকার আসাদ কায়সার। অধিবেশন ১২টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেলা দুটার পর শুরু হয়। দ্বিতীয় দফা অধিবেশন শুরু হলে পিটিআই আবারও অধিবেশন বিলম্বিত করার কৌশল নেয়। দলটির নেতা ও মন্ত্রীরা বেশি সময় ধরে বিরোধীদের উদ্দেশ্যে আক্রমণাত্মক বক্তৃতা শুরু করেন। এ সময় পার্লামেন্টে বার বার উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে শনিবারের অধিবেশনে ইমরান খান যোগ দেননি।
মুলতবি হয়ে যাওয়া অধিবেশন বেলা আড়াইটায় শুরু হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি বক্তব্য শুরু করেন। পার্লামেন্ট সূত্রের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়, অধিবেশন দেরিতে শুরু হওয়ায় ইফতারের পর রাত ৮টার দিকে অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। বিরোধীরা বলেন, অধিবেশন ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করা হয়েছে এবং ইমরান খানের দলের মন্ত্রীরা বক্তৃতা দীর্ঘ করার চেষ্টা করছেন। সাংবাদিক হামিদ মীর বলেন, ‘সংসদের অধিবেশন মুলতবি হওয়ার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি ভাষণ দেন। তার ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই অধিবেশন স্থগিত করা হয়। বিরতির পর তিনি আবারও ভাষণ শুরু করেন। ইমরান খান তাকে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা কথা বলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।’ এদিকে, অনাস্থা ভোট যাতে অনুষ্ঠিত না হয় সে জন্য অধিবেশন দীর্ঘায়িত করার সরকারের পরিকল্পনার পাল্টা কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরীফের চেম্বারে পরামর্শক বৈঠক করে দেশটির বিরোধী দলগুলো। পার্লামেন্টের অধিবেশনের বিরতির সময় এই বৈঠক করে তারা। পরে সরকারী ও বিরোধী দল সংসদে শৃঙ্খলা বজায় এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে বক্তৃতা দেয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়।
বৃহস্পতিবার পাক সুপ্রীমকোর্ট প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব খারিজের সিদ্ধান্ত বাতিল করেন এবং জাতীয় পরিষদ পুনর্বহাল করে ফের অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট গ্রহণের আদেশ দেন। সে আদেশ মোতাবেক শনিবার পাক পার্লামেন্টে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এসবের প্রেক্ষিতে শুক্রবার এক টুইটে সাবেক এই পাক ক্রিকেট অধিনায়ক বলেন, আমি সর্বশেষ বল পর্যন্ত খেলতে চাই। দেশবাসীর উদ্দেশে বলছি, আমি পাকিস্তানের জন্য শেষ বল পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। এদিকে পাক জাতীয় পরিষদ পুনর্বহাল ও ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব খারিজের আদেশ বাতিল করায় ইমরান বিরোধীরা বেশ চাঙ্গা। ইমরানের পর তারা প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য পাক মুসলিম লীগ নেতা শাহবাজ শরীফের নাম ঘোষণা করেছে। কিছু কিছু গণমাধ্যমে চাউর হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রস্তুতি নিতে বিরোধীরা ইতোমধ্যে এই মুসলিম লীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। বিরোধীরা মনে করছে, পাক রাজনীতিতে শনিবার অতি নাটকীয় কোন ঘটনা না ঘটলে এই ভোটের মাধ্যমেই বিদায় ঘণ্টা বাজবে ইমরান খানের। তাই তারা শাহবাজ শরীফকে এ পদের জন্য যোগ্য মনে করছে। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, অন্তর্র্বতী প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১ বছর। এই সময়ের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন দিতে হবে অন্তর্র্বতী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে। সুপ্রীমকোর্টের রায়ে আনন্দ প্রকাশ করে টুইটারে পিপিপি নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি লিখেন, ‘গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ প্রতিশোধ! জিও ভুট্টো, জিও আওয়াম, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। জাতীয় পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শীর্ষ আদালতের এ রায় গণমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। তিনি আরও বলেন, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সংবিধান ও পাকিস্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে। আদালতের স্বতন্ত্র ও মর্যাদা সমুন্নত থেকেছে। পার্লামেন্ট ও এর সার্বভৌমত্বকে দৃঢ় করতে সর্বসম্মতক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়ায় শীর্ষ আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন শাহবাজ শরীফ। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াই লড়ব।’ বৃহস্পতিবার রাতে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের এক বেঞ্চ ওই আদেশে পাক মন্ত্রিসভাকে পুনর্বহাল এবং শনিবার পার্লামেন্টে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আয়োজনের নির্দেশ দেন। প্রধান বিচারপতি ওমর আতা বন্দিয়াল বলেন, জাতীয় স্বার্থ এবং বাস্তব সম্ভাবনা দেখেই আদালত এগিয়ে এসেছেন। পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেয়ার অধিকার নেই প্রধানমন্ত্রীর। এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। এদিকে সর্বোচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার আগে ইমরান খান বলেছিলেন, শীর্ষ আদালতের যে কোন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত তিনি। ইমরান বলেছিলেন, আমরা সুপ্রীম কোর্টের যে কোন সিদ্ধান্ত মেনে নেব। পিটিআই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত এবং আমরা কোন বিদেশী ষড়যন্ত্র সফল হতে দেব না। সর্বোচ্চ আদালত দেয়ার রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়েছে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো। আর সরকার দলের প্রতিনিধিরা আদালতের এমন আদেশে অসন্তোষ জানিয়েছে। এই রায়কে দুর্ভাগ্যজনক অ্যাখা দিয়ে দেশকে আরও রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন ইমরান খানের সমর্থকরা। সংবিধান অনুযায়ী, নিজ মেয়াদে নির্বাচনী সংস্কার ও গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখেন অন্তর্র্বতী প্রধানমন্ত্রী। তবে ধারণা করা হচ্ছে, শপথ গ্রহণের পর দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে অগ্রাধিকার দেবে শাহবাজ শরীফের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার। শনিবার ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট হবে। পাক জাতীয় পরিষদের ৩৪২ জন সদস্যের মধ্যে যদি ১৭২ জন বিরুদ্ধে ভোট দেয় তা হলেই প্রধানমন্ত্রীর পদ হারাবেন ইমরান খান। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী ইমরান খানের বিরুদ্ধে প্রায় ১৯০ জন ভোট দেবেন। ফলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর গদি ছাড়তে হবে। তবে কিছু গণমাধ্যম আভাস দিয়েছে, শনিবার অনাস্থা ভোটের আগেই পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন ইমরান খান। পাক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোহেল ওয়ারিচ বলেন, ইমরান খান আরেকটি নাটকীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন। সেটি হলো তিনি ও তার দলের সদস্যরা গণহারে পদত্যাগ করতে পারেন। অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ ও পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলছে ইমরান সরকার। তাদের দাবি, অনাস্থা ভোট গ্রহণে আদালতের আদেশে ইমরান খানের ‘অভিযোগেরই জয় হয়েছে।’ পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ফররুখ হাবিব বলেছেন, ইমরান খানের ভয়ে সব ‘চোর’ এক হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ইমরান খানের দাবিরই জয় হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো টের পাবে, যারা বিদেশী ষড়যন্ত্রকে সমর্থন করেছে, জনগণ তাদের কীভাবে জবাব দেয়। যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে ইমরান খান বলে আসছেন, বিরোধী দলগুলোর আনা অনাস্থা প্রস্তাব ‘বিদেশী ষড়যন্ত্রের’ অংশ। অনাস্থা প্রস্তাব ব্যর্থ হলে পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে এক ‘চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছে।’