কাজিরবাজার ডেস্ক :
দিন দিন বাড়ছেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছে ৯ হাজারের বেশি রোগী। এসব রোগীর বেশিরভাগই আক্রান্ত হয়েছেন দূষিত পানির কারণে। কিন্তু সরকারের কোন পর্যায় থেকেই নেই পানি পরীক্ষা বা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কোন উদ্যোগ। পবিত্র রমজান মাসে সেহেরি এবং ইফতারের সময় এসব দূষিত পানি পান এবং এর তৈরি খাবার খেতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। তবে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় এতদিন ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপটি সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে তা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই এটি রোধে এখনি উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, সাধারণত এপ্রিল মাসে দেশে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। কিন্তু এ বছর মার্চের শুরুতেই রোগী বাড়তে শুরু করে আশঙ্কাজনক হারে। এ অবস্থায় রাজধানীতে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইসিডিডিআর’বির চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তার খাবার, বাসি-পচা খাবার খেলেও ডায়রিয়া হতে পারে। তবে ডায়রিয়া হবার মূল কারণ দূষিত পানি। খাবার পানিসহ নিত্য ব্যবহার্য পানিও হতে হবে বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ। কিন্তু কোনভাবে যদি খাবার পানির লাইনের সঙ্গে সুয়ারেজ লাইনের সংযোগ ঘটে যায় তাহলে পানি হয়ে পড়ে দূষিত।
দূষিত পানি থেকেই ডায়রিয়া বাড়ছে বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করার কারণ পানি দূষণ। তাই স্বাস্থ্য ভাল রাখতে হলে দেশের পানি, বায়ু ও মাটিকে ভাল রাখতে হবে। মন্ত্রী বলেন, ঢাকা শহরে দেড় কোটিরও বেশি লোক বসবাস করে। তাদের অনেকেই স্বাস্থ্যগত ক্ষতিকর পরিবেশে বসবাস করে থাকেন। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখ হচ্ছে। খাদ্যে ভেজালের কারণেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।
তবে এ দাবি অস্বীকার করেছেন রাজধানীতে পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার পানির সঙ্গে ডায়রিয়ার কোন সম্পৃক্ততা নেই। আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে আমাদের ঘনঘন যোগাযোগ আছে। তারা যখনই ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায় তখনই ১০টি এলাকার ঠিকানা আমাদের দেয়, সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওইসব এলাকার পানি ল্যাবে টেস্ট করাই। সেই ল্যাব টেস্টে আমরা কোন ব্যাকটেরিয়া পাইনি। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে আইসিডিডিআর’বিকে জানিয়েছি।
তিনি বলেন, পানিতে যদিওবা কোন জীবাণু থাকে, সেটি যাতে মরে যায় বা ধ্বংস হয়ে যায় সেজন্য ক্লোরিন দিয়ে থাকি। অনেক সময় ক্লোরিন পাইপের শেষ মাথা পর্যন্ত যায় না। কিন্তু আমরা ওই বিশেষ স্থানগুলোতে ক্লোরিন বাড়িয়ে দিয়েছি। এই ডায়রিয়ার সঙ্গে আমাদের ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে যা পেয়েছি, তাতে কোন সম্পৃক্ততা সরাসরি নেই। আর ক্লোরিন মেশানোর কারণে পানিতেও গন্ধ পাওয়া যায় না। এই গন্ধ দূর করতে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড পানি ও আমাদের শোধন করা পানির মিশ্রণ করে সরবরাহ করি।
কিন্তু মূলত দূষিত পানির কারণেই ডায়রিয়া বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন আইসিডিডিআর’বিতে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ রোগীরা। তাই তাদের আহ্বান সরকারের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ডায়রিয়ার আক্রান্ত যেসব এলাকার রোগী বেশি সেসব এলাকায় গবেষণা চালানোর। এবং এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার আইসিডিডিআর’বির মিডিয়া ম্যানেজার তারিফ হাসান জানান, আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে আট হাজার ৬১২ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছেন। তিনি জানান, চলতি মাসের ১ তারিখে হাসপাতালটিতে নতুন করে ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হন এক হাজার ২৭৪ জন, ২ এপ্রিল এক হাজার ২৭৪ জন, ৩ এপ্রিল এক হাজার ১৭১ জন, ৪ এপ্রিল এক হাজার ৩৮৩ জন, ৫ এপ্রিল এক হাজার ৩৭৯ জন, ৬ এপ্রিল আরও এক হাজার ৩৭০ জন এবং বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত ৭৬১ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে গত ১৬ মার্চ এক হাজার ৫৭ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরদিনই (১৭ মার্চ) আরও এক হাজার ১৪১ জন রোগী ভর্তি হন। এরপর যথাক্রমে ১৮ মার্চ এক হাজার ১৭৪ জন, ১৯ মার্চ এক হাজার ১৩৫ জন, ২০ মার্চ এক হাজার ১৫৭ জন, ২১ মার্চ এক হাজার ২১৬ জন, ২২ মার্চ এক হাজার ২৭২ জন ভর্তি হন। ২৩ মার্চ এক হাজার ২৩৩ জন, ২৪ মার্চ এক হাজার ১৭৬ জন, ২৫ মার্চ এক হাজার ১৩৮ জন, ২৬ মার্চ এক হাজার ২৪৫ জন এবং ২৭ মার্চ এক হাজার ২৩০ জন, ২৮ মার্চ এক হাজার ৩৩৪ জন, ২৯ মার্চ এক হাজার ৩১৭ জন, ৩০ মার্চ এক হাজার ৩৩১ জন এবং ৩১ মার্চ এক হাজার ২৮৫ জন রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন।
উর্ধমুখী এ রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালটির চিকিৎসকদের। হাসপাতালটির বারান্দার আনাচে-কানাচেও রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। হাসপাতালের প্রধান ডাঃ বাহারুল আলম বলেন, আমাদের মোট শয্যা সংখ্যা ছিল ৪৬৮টি। রোগীর চাপ বাড়ায় তাঁবু খাটিয়ে প্রথমে শয্যা বাড়ানো হয় ৮৯টি। পরবর্তীতে আরও ৫০টি শয্যা বাড়ানো হয়। কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে ভর্তি রোগীর সংখ্যা। তাই হাসপাতালের বারান্দাগুলো পর্যন্ত রোগীদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে উঠে। এতে করে স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন হচ্ছিল। তাই আরও ৪০টি শয্যা বাড়ানো হয়। এই পরিমাণ রোগী বাড়তে থাকলে চিকিৎসা দেয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তাই এই হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে ঢাকা মেডিক্যালসহ অন্যান্য হাসপাতালে ডায়রিয়ার রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষ সেবা চালুর আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, ডায়রিয়া একটি পানিবাহিত রোগ। ইনজেকশন বা রক্তের মাধ্যমে রোগটির জীবাণু শরীরে যাবে না। এটা পানির মাধ্যমে মুখ দিয়েই শরীরে যাবে। যে কোন উপায়ে তারা দূষিত পানি খেয়েছে। সেটা ওয়াসারও হতে পারে বা অন্য কোন কারণেও দূষিত হতে পারে। এটি বের করা গবেষকদের কাজ।