স্পোর্টস ডেস্ক :
রঙিন পোশাকের ওয়ানডেতে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পর আত্মবিশ্বাসে টগবগে ছিল বাংলাদেশ, যে কারণে আভিজাত্যের টেস্ট ক্রিকেটেও আফ্রিকাভূমি জয়ের স্বপ্ন নিয়ে প্রথম টেস্টে মাঠে নামেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। চারদিন অনেকটা সমানতালে লড়াই করা মুমিনুল হকের দল সোমবার পঞ্চম ও শেষ দিনে জয়ের স্বপ্ন নিয়েই মাঠে নেমেছিল। কিন্তু আচমকা ঝড়ে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মুড়িমুড়কির মতো উইকেট হারিয়ে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫৩ রানে অলআউট হয়েছে সফরকারী বাংলাদেশ। ফলে হার ২২০ রানের বড় ব্যবধানে। ২৭৪ রানের জয়ের লক্ষ্যে নেমে এক ঘণ্টার মধ্যে (৫৫ মিনিট) গুটিয়ে যায় টাইগাদের ইনিংস। অর্থাৎ ডারবানে আচমকা ঝড়ে ডুবে গেছে বাংলাদেশের তরী!
অথচ ডারবানের কিংসমিডে হওয়া এই টেস্ট ম্যাচটি জয়ের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। শুরুটাও পছন্দমতো হতে পারত। কিন্তু টস জিতে মুমিনুল হক অবিশ্বাস্যভাবে কেন প্রোটিয়াদের ব্যাটিংয়ে পাঠালেন তা সবার কাছেই বিস্ময়। যে কারণে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে হয়েছে টাইগারদের। টেস্ট ক্রিকেটে যা বরাবরই কঠিন। সেই সঙ্গে চতুর্থ দিনে বিরূপ আম্পায়ারিংয়েরও শিকার হতে হয়েছে। এরপরও শেষ দিনে জয়ের স্বপ্ন নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন মুশফিক, লিটন, মিরাজরা। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার দুই স্পিনার কেশভ মহারাজ আর সাইমন হারমার কোন প্রতিরোধই গড়তে দেননি টাইগার ব্যাটারদের।
টস হেরে প্রথমে ব্যাট পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের প্রথম ইনিংসে ১২১ ওভারে ৩৬৭ রান করে অলআউট হয়। জবাবে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস ১১৫.৫ ওভারে ২৯৮ রানে গুটিয়ে যায়। যে কারণে প্রথম ইনিংসে ৬৯ রানে এগিয়ে থাকে প্রোটিয়ারা। দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা ৭৪ ওভারে ২০৪ রান করে অলআউট হলে তারা সব মিলিয়ে এগিয়ে যায় ২৭৩ রানে। ফলে জয়ের জন্য দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৭৪ রান। এই রান তাড়া করতে যেয়ে চতুর্থ দিনের শেষভাগেই পা হড়কে ফেলে মুমিনুল হকের দল। ১১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে হয়ে পড়ে দিকভ্রান্ত। এরপরও পঞ্চম ও শেষ দিনে স্বপ্ন নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন টাইগার ব্যাটাররা। কিন্তু দিনের প্রথম ওভার থেকেই উবে যেতে থাকে সে স্বপ্ন। মূলত দুই স্পিনার মহারাজ ও সাইমন হারমারের বিষধর ঘূর্ণি বলে অসহায় আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ। ফলাফল পঞ্চম দিনে ১৩ ওভারেই সব শেষ। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছে ১৯ ওভার। আর অলআউট মাত্র ৫৩ রানে।
বেদনার বড় এই হারের পথে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২৬ রান করেন নাজমুল হোসেন শান্ত। আর মাত্র একজন ব্যাটারই দুই অঙ্কের ঘরে যেতে পারেন। তিনি হলেন ১৪ রান করা পেসার তাসকিন আহমেদ। বাকিরা ছিলেন যাওয়া-আসার মিছিলে। মাহমুদুল হাসান জয় ৪, সাদমান ইসলাম ০, অধিনায়ক মুমিনুল হক ২, মুশফিকুর রহীম ০, লিটন দাস ২, ইয়াসির আলী ৫, মেহেদি হাসান মিরাজ ০, দুই পেসার খালেদ আহমেদ ০ ও এবাদত হোসেন (অপরাজিত) ০। দুই স্পিনার দিয়ে আক্রমণ সাজানো দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যবহার করতে হয়নি আর কোন বোলার। ১০ ওভার বল করে ৩২ রান খরচায় বাঁহাতি স্পিনার কেশভ মহারাজ একাই কব্জা করেন ৭ উইকেট। ম্যাচসেরাও হয়েছেন তিনি। ২১ রান খরচায় বাকি ৩ উইকেট নিয়েছেন ডানহাতি অফব্রেক বোলার সাইমন হারমার। এই জয়ে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
আচমকাই ভেঙেপড়া ব্যাটিংয়ের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে লেপ্টে গেছে বেশ কিছু বিব্রতকর রেকর্ড। ৫৩ রান টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ। এর আগে ২০১৮ সালে এ্যান্টিগায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৪৩ রানে অলআউট হয়েছিল বাংলাদেশ। ওভারের হিসেবেও দ্বিতীয় ছোট ইনিংস এটি (১৯ওভার)। এ্যান্টিগায় টাইগাররা অলআউট হয়েছিল ১৮.৪ ওভারে। সর্বনিম্ন রানের লজ্জা থেকে রেহাই পেলেও চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন রান এটিই। আগের সর্বনিম্ন ছিল এই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেই ৯০ রান, যা হয়েছিল ২০১৮ সালে। তবে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী ডারবানে সর্বনিম্ন দলীয় রানের লজ্জায় ঠিকই পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। এই ৫৩ রানের আগে ডারবানে সর্বনিম্ন দলীয় রান ছিল ৬৬। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে যা করেছিল ভারত। ২৬ বছর পর ভারতের সেই কলঙ্ক মুছে দিয়েছে বাংলাদেশ!
হাতছানি ছিল ইতিহাস গড়ার; কিন্তু হয়েছে একগাদা বিব্রতকর রেকর্ড। সঙ্গত কারণেই টাইগার তাঁবু আছে অস্বস্তিতে। অথচ শেষ দিনে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল শেষ সেশন পর্যন্ত ব্যাটিং করা। আর সেটা করতে পারলে আসতে পারত আরেকটি ইতিহাসগড়া জয়। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ কাপ্তান মুমিনুল হক বলেন, ‘আমরা বলের মেধাগুণ বিচার করে খেলার চেষ্টা করছি। শেষ সেশন পর্যন্ত ব্যাট করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আগের দিন আমরা ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলি, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’ ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই স্পিনার মিলেই তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশ দশ উইকেট। এর মধ্যে মহারাজ নিয়েছেন একাই ৭ উইকেট। যা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চতুর্থ ইনিংসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। স্পিনের বিরুদ্ধে ভাল খেলতে না পারায় দায় নিয়ে টাইগার অধিনায়ক বলেন, ‘আমরা স্পিনের বিরুদ্ধে খেলে অভ্যস্ত। এটি জানতাম যে, ডারবানে তৃতীয় ও চতুর্থ দিনের পর স্পিন ধরে। আমরা ব্যাট হাতে নিজেদের সামর্থ্য দেখাতে পারিনি। অনেক বাজে শট খেলেছি। তবে প্রথম ইনিংসে ভালই ছিল।’
ব্যাটিং ব্যর্থতায় হারলেও দলের বোলারদের ভূয়সী প্রশংসা করেন টাইগার অধিনায়ক। এর প্রমাণ বাংলার বোলররা দুই ইনিংসেই প্রোটিয়াদের অলআউট করে ২০ উইকেট নিয়েছেন। এবাদত হোসেন, খালেদ আহমেদ, মেহেদি হাসান মিরাজরা তাদের আসল কাজটি ভালমতোই করেন। বিষয়টি স্মরণ করে মুমিনুল বলেন, ‘দুই ইনিংসেই বোলাররা ভাল বোলিং করেছি। গত কয়েক ম্যাচ ধরেই আমাদের পেস ডিপার্টমেন্ট দারুণ করছে। নিউজিল্যান্ডেও তারা অসাধারণ ছিল, এখানেও ওয়ানডে সিরিজেও।’ টাইগার কান্ডারি বলেন, ‘আমরা দ্বিতীয় ইনিংসে ৫০ থেকে ৬০ রান বেশি দিয়ে ফেলেছি। আমাদের হাতে আরেকটি ম্যাচ আছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সামনে আসা সুযোগগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে।’