বোরোর রেকর্ড আবাদ, ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশেই মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ। সবুজের এই সমারোহ জানিয়ে দিচ্ছে সামনেই দেশের প্রধান ফসল বোরো আসছে। কৃষি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এবছর দেশজুড়ে বোরো ধানের আশাতীত আবাদ হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে বোরো আবাদের অতীতের সব রেকর্ড। বাজারে ধানের চড়া দামই কৃষকদের উৎসাহ জুগিয়েছে বোরো আবাদে। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারের নানা প্রণোদনা। সব মিলিয়ে এ বছর বোরো আবাদ শুধু লক্ষ্যমাত্রাই ছাড়াইনি, সৃষ্টি করেছে আবাদের নতুন রেকর্ড। ফলে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এ বছর বোরো চাল উৎপাদনেও নতুন রেকর্ড সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সব ঠিকঠাক থাকলে অর্থাৎ কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে এবছর বোরো চাল উৎপাদন ২ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, এ বছর ২০২১-২২ মৌসুমে দেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রিড ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টর এবং উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদের লক্ষ্য ছিল ৩৬ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর। বাকিটা স্থানীয় জাত। চাল আকারে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টন। এর মধ্যে হাইব্রিড চাল ৬০ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের চাল এক কোটি ৪৮ লাখ ২৬ হাজার টন। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ধরা হয়েছে ৪.৩০ টন।
কৃষকদের আশাতীত সাড়ার কারণে এ বছর দেশে বোরো আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদ বেড়েছে প্রায় দুই শতাংশ জমিতে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধানের আবাদ প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৩১ হাজার হেক্টরে এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের আবাদ প্রায় এক শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ লাখ ১১ হাজার হেক্টরে। অন্যদিকে স্থানীয় জাতের ধানের আবাদও প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে। কমে যাওয়া এসব জমিতে হাইব্রিড ধান আবাদ হয়েছে এ বছর। অর্থাৎ সরকারের নানাবিধ সুবিধা ও প্রণোদনার কারণে আস্তে আস্তে দেশে হাইব্রিড ধানের আবাদ বেড়েছে। ফলে সব মিলিয়ে এ বছর বোরো চাল উৎপাদন ২ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এখন ধান গাছ থেকে শীষ বের হচ্ছে। কোথাওবা শীষ বের হয়ে তা ধানে পুষ্ট হচ্ছে। আর এক মাসের মধ্যেই সারাদেশে শুরু হবে ধান কাটা উৎসব। সবার আগে এই উৎসবে মাতবে দেশের হাওড় অঞ্চল। সরকার পক্ষ থেকেও ধান কাটার ব্যাপারে কৃষকদের সর্বাত্মক সহায়তার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এ বছর ধান কাটার যন্ত্র আরও বাড়ানো হবে। যাতে কৃষক দ্রুত ধান কেটে ঘরে তুলতে পাারে। বিশেষ করে হাওড়ের ধান যাতে দ্রুত কেটে ঘরে তুলতে পারে সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তবে সব কিছুই নির্ভর করবে প্রকৃতির ওপর। প্রকৃতি সহায়ক হলে এ বছরও বোরো উৎপাদন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বোরো আবাদ বৃদ্ধির পেছনে দুটি কারণ কাজ করছে। একটি হচ্ছে ধানের উচ্চ মূল্য এবং অন্যটি হচ্ছে সরকারের প্রণোদনা। গত এক বছর ধরে দেশে ধানের সর্বোচ্চ মূল্য অব্যাহত রয়েছে। ফলে এ বছর বোরো আবাদে কৃষকদের ব্যাপক সাড়া দেখা গেছে। অন্যদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে রবি মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার সহায়তা প্রদান কর্মসূচী নেয়া হয়। এতে ৬ লাখ কৃষকের মাঝে ৫ কেজি করে বীজ, ১০ কেজি করে ডিএপি এবং ১০ কেজি করে এমওপি সরবরাহ করা হয়েছে। মূলত এই দুই কারণেই দেশে চলতি বছর রেকর্ড বোরো আবাদ হয়েছে। আর কৃষক এ বছর বোরো আবাদ বাড়াতে গিয়ে গম এবং সবজি আবাদ কম করেছে। অর্থাৎ গত এক বছর ধরে ধানের বেশি দাম পাওয়ায় কৃষক গম ও সবজির পরিবর্তে বোরো ধান আবাদ করেছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল কী করে আরও বেশি জমি আবাদের আওতায় নিয়ে আসা যায়। এজন্য আমরা কৃষকদের নানাবিধ প্রণোদনা দিয়েছি। ফলে এবার আমরা অনেক বেশি বোরো জমি আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। সেই সঙ্গে উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান ৮৯ জাত ও হাইব্রিড জাতের আবাদ এ বছর বেশি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আশা করছি, এ বছরও বোরো উৎপাদন গত বছরের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি। কারণ জমি কমে যাচ্ছে। তাই দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অল্প জমি থেকে বেশি ধান উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই এ বছর বোরো আবাদ বাড়ানো হয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, মানুষের জীবনযাত্রা বাড়ছে। ফলে দেশে সরু চালের চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য হলো নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে জমি বাড়ছে না। কিন্তু বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মিটানোর জন্য ধান ফসলের আবাদ ও মোট উৎপাদন বাড়ানো দরকার। বোরো ধান ফসলের মধ্যে অন্যতম। মোট উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বোরো ধান ফসলের উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন জাতের আবাদ বাড়ানো প্রয়োজন। এ কারণেই হাইব্রিড ধানের আবাদ বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে দেশে হাইব্রিড ধানের আবাদ বৃদ্ধির জন্য ২০২১-২২ কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বীজ সহায়তা প্রণোদনা কর্মসূচীর আওতায় ৬৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা অর্থায়নে দেশের ৬৪ জেলায় ১৫ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন বীজ কৃষকের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। এতে এ বছর হাইব্রিড ধানের আবাদ বেড়েছে।
হাইব্রিড আবাদের প্রতি গুরুত্ব প্রদানের যৌক্তিকতা তুলে ধরে কর্মকর্তারা আরও বলেন, উচ্চ ফলনশীল জাতের তুলনায় হাইব্রিড ধান চাষে ফলন ৩০-৪০ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়। এই ধান চাষে তুলনামূলকভাবে বীজ কম লাগে। আবার বিশুদ্ধ বীজের নিশ্চয়তা সর্বাধিক। সরকারী গুদাম ও মিলারদের নিকট হাইব্রিড ধান বিক্রয়ের সুযোগ থাকায় হাইব্রিড ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহ বেড়ে চলেছে। এছাড়া প্রণোদনা কর্মসূচীতে হাইব্রিড ধানের বীজ সরবরাহ করায় কৃষক পর্যায়ে হাইব্রিড চাষের উৎসাহ বেড়েছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর দেশে বোরো আবাদ বৃদ্ধি পেলেও কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিশেষ করে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এ বছর সেচ খরচ বেড়ে গেছে। ২০২১ সালের নবেম্বর মাসে সরকার ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে প্রতি লিটার ৮০ টাকায় নির্ধারণ করে। ফলে এ বছর ডিজেলচালিত সেচ ও ট্রাক্টর খরচ বেড়েছে। বিঘা প্রতি এ বছর শুধু সেচ খরচই বেড়ে গেছে ৩০০ টাকা। বিদ্যুতের দাম না বাড়লেও বিদ্যুতচালিত সেচেও বিঘায় ৩০০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষি শ্রমিকের মজুরিও এ বছর বেড়েছে। ফলে সবমিলিয়ে এ বছর কৃষকের বোরোর উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এ বছর দেশে বোরো আবাদ বেড়েছে সঠিক। বোরো আবাদ ব্যয়বহুল। ফলে খরচ কুলাতে না পারার কারণে প্রতি বছর দেশের অনেক বোরো জমি পতিত থাকে। ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষক এ বছর সব পতিত জমি আবাদ করেছে। ফলে এ বছর দেশে বোরো আবাদ বেড়েছে।
বোরো উৎপাদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বছর আমরা দুই কোটি ৫ থেকে ৭ লাখ বোরো চাল উৎপাদনের আশা করছি। এর কারণ হচ্ছে, বরেন্দ্র এলাকায় অনেক কৃষক পানির অভাবে সেচ দিতে পারছে না। অন্য এলাকায়ও সেচের পানি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সব সময় বিদ্যুত পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের ৬০ শতাংশ সেচ যন্ত্র চলে ডিজেলে। সরকার ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। ফলে কৃষককে বেশি দামে সেচ দিতে হচ্ছে। ফলে খুব বেশি উৎপাদন আশা করা কঠিন। বোরো ধান উঠতে এখনও প্রায় এক মাস বাকি। এই সময়ে প্রকৃতির অবস্থা কেমন দাঁড়ায় তার ওপর নির্ভর করছে উৎপাদন। তাই বোরো উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে অনেক বাধা আছে।
তবে উৎপাদন যাই হোক না কেন তার সঠিক পরিসংখ্যান যেন উঠে আসে তার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বাজারে এখনও চালের দাম বেশি। আর এক মাসের মধ্যেই নতুন বোরো ধান উঠবে। ফলে কৃষকদের কাছে যদি মজুদ থাকত তা এই সময়ে বাজারে চলে আসত। কারণ নতুন ধান উঠলে দাম কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা হচ্ছে না। তার মানে কৃষকদের কাছে মজুদ খুব বেশি নেই। তাই সরকারের হস্তক্ষেপ করার জন্য উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান জানা দরকার। এতে আগামী বছর কী পরিমাণ চাল আমাদানি করতে হবে, নাকি আমদানি করতে হবে নাÑ এই পরিকল্পনা করতে সুবিধা হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, গত পাঁচ বছরে দেশে বোরো আবাদ বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। ২০১৬-১৭ মৌসুমে দেশে যেখানে ৪৫ লাখ ১৭ হাজার ২৫৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল, সেখানে ২০২১-২২ মৌসুমে বোরো আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার ১৯৮ হেক্টর জমিতে। মোট আবাদ বেড়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ। এই পাঁচ বছরে দেশে হাইব্রিড আবাদ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে যেখানে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৩ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধানের আবাদ হয়েছিল, সেখানে ২০২১-২২ মৌসুমে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৩ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরে দেশে হাইব্রিড আবাদ বেড়েছে ৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে মোট বোরো আবাদের ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ এলাকায় হাইব্রিড ধান আবাদ হচ্ছে। এটা দেশে ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আশাজনক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠ চিত্র অনুযায়ী, এই পাঁচ বছরে দেশে চাল আকারে বোরো উৎপাদন বেড়েছে ১৯ লাখ ৭৩ হাজার টন। ২০১৬-১৭ সালে যেখানে দেশে বোরো চাল উৎপাদিত হয়েছিল এক কোটি ৭৮ লাখ ২৫ হাজার ২১৪ টন, সেখানে ২০২০-২১ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার ২৬৩ টন। আর চলতি বছর ২ কোটি ১৩ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদনের আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) হিসাবে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) হিসাবের পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিবিএসের হিসাবে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে বোরো চাল উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ৯৮ লাখ ৮৫ হাজার টন। অন্যদিকে, ডিএই’র হিসাবে এই উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার টন। শুধু উৎপাদনই নয়, আবাদের ক্ষেত্রে দুই সংস্থার পরিসংখ্যানে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিএই’র হিসাবে দেশে বোরো আবাদ হয়েছিল ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে। অথচ বিবিএসেরে হিসাবে আবাদ হয়েছে ৪৭ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে।