সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সিলেটে চাঞ্চল্যকর বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল চিন্তার লেখক ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলায় ৪ জঙ্গির ফাঁসি (মৃত্যুদন্ড) ও এক আসামীকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি প্রত্যেক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদেরকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। প্রায় ৭ বছর পর গতকাল বুধবার দুপুরে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব চাঞ্চল্যকর এই রায় ঘোষণা করেন।
সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি এডভোকেট মুমিনুর রহমান টিটু ৪ আসামির মৃত্যুদন্ড এবং একজনের খালাস পাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হচ্ছে, সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন (২৫), একই উপজেলার খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ (২৭), সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বিরেন্দ্রনগরের (বাগলী) মামুনুর রশীদ (২৫) ও কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ (২৫)। ও খালাসপ্রাপ্ত নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাফিউর রহমান উরফে ফারাবী উরফে সাফিউর রহমান (৩০)। মৃত্যুদন্ড পাওয়া এই ৪ জনের মধ্যে আবুল হোসেন, ফয়সাল আহমদ ও মামুনুর রশীদ বর্তমানে পলাতক রয়েছে। গতকাল রায় ঘোষনার সময় সাফিউর রহমান উরফে ফারাবী ও আবুল খায়ের রশীদ আহমদ আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১২ মে সিলেট নগরীর সুবিদবাজারে নুরানি আবাসিক এলাকার নিজ বাসার সামনে খুন হন অনন্ত বিজয় দাশ। পেশায় ব্যাংকার অনন্ত বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি ‘যুক্তি’ নামে বিজ্ঞানবিষয়ক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এ ছাড়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। হত্যাকান্ডের পর অনন্তের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ বাদী হয়ে এসএমপি এয়ারপোর্ট থানায় অজ্ঞাতনামা ৪ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির কারণে অনন্তকে ‘উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী’ পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। মামলাটি পুলিশ থেকে পরবর্তীতে অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়। সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী তদন্ত করে ২০১৭ সালের ৯ মে সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। এতে সন্দেহভাজন আটক ১০ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলায় ২৯ সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। পরে ১৪ মার্চ পলাতক তিন আসামির যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেন।
আদালত সূত্র আরো জানায়, আসামিদের মধ্যে ফারাবী এবং আবুল খায়ের এখন কারাগারে আছেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর কানাইঘাটের পূর্ব ফালজুর গ্রামের মান্নান ইয়াইয়া ওরফে মান্নান রাহী ইবনে মঈন (২৪) ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বাকি ৩ আসামি এখনো পলাতক। প্রথম দিকে এই মামলার বিচারকাজ চলে সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। পরে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০২০ সালের শুরুর দিকে মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুল আহাদ জানান, এই রায়ে ন্যায়বিচার গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আমরা আশা করছি- মহামান্য হাইকোর্টে ন্যায়বিচার পাবো।
রায় ঘোষণার পর অনন্তের বড় বোনের স্বামী ও সিলেট কর আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সমর বিজয় সী শেখর বলেন, ছেলে খুন হওয়ার পর অনন্তের বাবা রবীন্দ্র কুমার দাশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৯ সালে তিনি মারা যান। মা পীযূষ রানী দাশও ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমানে প্রায় শয্যাশায়ী বলা যায়। গতকাল বুধবার রায় ঘোষণা হয়েছে। এখন দ্রুত এই রায় কার্যকর হোক।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মনির উদ্দিন বলেন, নৃশংসভাবে অনন্তকে হত্যা করা হয়েছে। এ জন্য মৃত্যুদন্ডই সর্বোচ্চ শাস্তি। আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে ফারাবীকে কেন আদালত খালাস দিয়েছেন, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর বোঝা যাবে। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেয়ে অনন্তের পরিবারের সদস্য এবং বাকি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি দাবি করেন, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের শাস্তির রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক।
রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি এডভোকেট মুমিনুর রহমান টিটু জানান, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হলেন আবুল হোসেন, ফয়সাল আহমদ, মামুনুর রশীদ (২৫) ও ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ (২৫)। আর খালাস পেয়েছেন সাফিউর রহমার ফারাবী। তিনি বলেন, রায় ঘোষণার সময় আবুল খায়ের রশীদ আহমদ এবং সাফিউর রহমান ফারাবী উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে আবুল হোসেন, ফয়সাল আহমদ ও মামুনুর রশীদ পলাতক। এছাড়া আরেক আসামী মান্নান ইয়াহইয়া ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এদিকে, মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিহত ও লেখালেখি চিরতরে স্তব্ধ করতেই অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয়েছে। তাকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীলতা চর্চাকারীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়াই ছিলো খুনিদের মূল উদেশ্য।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত উল্লেখ করেন, অনন্ত বিজয় বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল চিন্তার লোক ছিলেন। তিনি ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন। অনন্ত বিজয় দাশের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে প্রতিহত করার জন্য এবং তার লেখনীকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য সন্ত্রাসী কায়দায় প্রকাশ্যে দিবালোকে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। হত্যাকান্ডের নৃশংসতা ও বীভৎসতা দ্বারা যে সকল লেখক মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান ও সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার বিষয়ে লেখেন বা বক্তব্য দেন তাদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়াই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। আদালত আরও বলেন, জনমনে ভীতির সঞ্চার করে এবং জননিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে ভিকটিম হত্যা করে এই আসামিগণ গর্হিত অপরাধ করেছেন- যা বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে অনুজ্জ্বল করেছে। ফলে এই আসামিদের দন্ড প্রদানের ক্ষেত্রে আদালতের কোন অনুকম্পা পেতে হকদার নয়। বরং এই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে অন্যান্য সন্ত্রাসী জঙ্গি উগ্রবাদী মতাদর্শের লোকজন এই ধরনের হত্যাকান্ডে উৎসাহিত হবে।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, অনন্তকে হত্যার পরপরই টুইটারে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এই হত্যার দায় স্বীকার করলেও বাংলা টিম বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ সত্ত্বার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। মামলা থেকে শফিউর রহমান ফারাবিকে খালাস প্রদান প্রসঙ্গে আদালত বলেন, হত্যাকান্ডের সময়ে ফারাবি অন্য মামলায় কারাগারে ছিলেন।