কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে জঙ্গীবাদ ও মাদক নির্মূলের পাশাপাশি মহামারীতে র্যাবের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছেন, কোন কারণ ছাড়াই এ বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ‘অত্যন্ত গর্হিত কাজ’। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) অপরাধীদের রক্ষা করে ও তাদের দেশে আশ্রয় দেয় এবং কোন প্রকার অপরাধ ছাড়াই আমাদের দেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটাই তাদের চরিত্র। কাজেই তাদের ব্যাপারে এ ছাড়া আমি আর কি বলতে পারি। সোমবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন উপলক্ষে রাজধানীতে বাহিনীটির সদরদফতরের লে. কর্নেল আজাদ মোমোরিয়াল হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যে দেশ জাতির পিতার হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিক মর্যাদা দিয়ে আশ্রয় দেয়, সেই দেশ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর বিনা অপরাধে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। হলি আর্টিজানের ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মানুষকে উদ্ধার করতে পেরেছে বাংলাদেশ। জলদস্যু, বনদস্যু বা মাদক নিয়ন্ত্রণের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে র্যাব সফলতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের এই সাফল্যগুলোতে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) কোন দুঃখ পেয়েছে কি না, তা আমি বলতে পারি না। কিন্তু বাংলাদেশ যে এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে, এটা হলো সত্য। আর সেই ক্ষেত্রে এই ধরনের একটা স্যাঙ্কশন জারি করা, এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে আমি মনে করি।
প্রধানমন্ত্রী একই অনুষ্ঠানে র্যাব ২, ১০, ১৩ ও ১৪’র ব্যাটালিয়ন সদরদফতর, র্যাব ফোর্সেস ট্রেনিং স্কুল, ‘মুজিব কর্ণার’ সংবলিত র্যাব হেরিটেজ মিউজিয়াম উদ্বোধন করেন। তিনি র্যাব-৩ ব্যাটালিয়ন সদরদফতরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। র্যাবের ১৫ ব্যাটালিয়নের প্রত্যেকটি ভার্চুয়ালি এ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে র্যাবের বিভিন্ন কর্মকা- এবং সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এই বাহিনীর সফলতার একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র্যাব গঠন করা হয় এবং একই বছরের ২১ জুলাই এই বাহিনী অভিযান শুরু করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধাপরাধী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত সাজাপ্রাপ্ত খুনীদের আশ্রয় এবং তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করে, সেসব খুনীদের ফেরত পাঠাতে তার সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের কাছে বার বার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু তাদের ফেরত পাঠানোর পরিবর্তে তাদের দেশে তারা খুনীদের আশ্রয় দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা কথা আমি স্পষ্ট বলতে চাই, সেটা হলো আমাদের দেশে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা বা র্যাব বা পুলিশ বা যে কেউ তারা নিজেরা যদি কোন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, আমরা কিন্তু তার শাস্তির ব্যবস্থা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, যারা বিনা কারণে, বিনা দোষে র্যাবের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে স্যাঙ্কশন জারি করেছে, তাদের দেশে কিন্তু এ ধরনের অপরাধ করলে তারা তাদের কোন বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।’
যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পুলিশের হাতে আফ্রো-আমেরিকানদের নির্যাতিত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে ছোট বাচ্চা ছেলে, জাস্ট পকেটে হাত দিয়েছে, তাকে গুলি করে মারল। অথবা রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে গলা চেপে মেরে ফেলে দিল। সেখানে যদি এই ধরনের অপরাধ কেউ করে, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে যদি কেউ অপরাধ করে, অপরাধ করলেও তাদের সেভাবে কোন শাস্তি দেয়া হয় না। কিন্তু বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, পধথিবীতে যেখানে কেউ অপরাধ করলে আমরা তার শাস্তির বিধান করি।’
যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে ‘কিছু বাংলাদেশী’র হাত থাকারও ইঙ্গিত করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমাদের দেশের কিছু মানুষ তারাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালায়। আর যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে বসে বসে, তারা কিন্তু অপরাধী। কোন না কোন দোষে হয়তো চাকরি হারিয়েছে বা দেশ ছেড়েছে। তিনি বলেন, আমি জানি না কী কারণে হলি আর্টিজান ক্যাফে হামলাসহ জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে র্যাবের সফলতায় কেন যুক্তরাষ্ট্রে কষ্ট পেল।
প্রধানমন্ত্রী র্যাব সদস্যদের আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি রমজান মাসকে সামনে রেখে কতিপয় কালোবাজারির নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি ঠেকাতে যে কোন ধরনের মজুদদারির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে র্যাব সদস্যদের নির্দেশ দেন।
অবৈধ মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে র্যাব এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে সফল হলেও প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান আরও বৃদ্ধি করতে র্যাব সদস্যদের নির্দেশ দেন। তিনি সমাজ থেকে মাদক সম্পূর্ণভাবে উৎপাটন না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত রাখারও নির্দেশ দেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জন¯্রােত ও সেখানে ক্রমবর্ধমান অপরাধের ব্যাপারে সরকারপ্রধান বলেন, ওই জেলায় র্যাবের একটি সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন মোতায়েনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে র্যাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং এভাবে তারা জাতির উন্নয়নে অবদান রাখছে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে র্যাবের অবদান অপরিসীম। দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজমান থাকায় আমরা প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনা নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। দেশব্যাপী ১শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণের পূর্বশর্ত। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে প্রচুর দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ অপরিহার্য।
সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ, মাদক, সুন্দরবনে জলদস্যু ও বনদস্যু এবং দক্ষিণাঞ্চলে চরমপন্থী নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধানমন্ত্রী র্যাবের প্রশংসা করেন। সমাজে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনি র্যাব ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের জন্য র্যাবের প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সুন্দরবনের জলদস্যু ও বনদস্যু এবং দক্ষিণাঞ্চলে চরমপন্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। আত্মসমর্পণের পর সরকার তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তারা এখন তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, তার সরকার র্যাবকে আরও শক্তিশালী ও আধুনিকায়নের জন্য কাজ করছে। দুর্গম এলাকাগুলোতে অভিযান পরিচালনা সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তারা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, র্যাব এখন সড়ক, আকাশ ও নৌ-তিন পথেই অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা প্রতিটি বাহিনীকে উন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছি। করোনাভাইরাস মহামারীকালে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও এই মহৎ কাজে তাদের জীবন উৎসর্গের জন্য একটি বাহিনী হিসেবে র্যাবের ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালে যেসব র্যাব সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন, তাদের রুহের মাগরিফাত কামনা করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং দেশের মানুষকে একটি সুন্দর ও উন্নত জীবন উপহার দেয়ার লক্ষ্যে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান।