কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেছেন, দেশের শিশুদের জন্য আমরা সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ রেখে যেতে চাই। তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দিয়ে গেলাম। আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এই মর্যাদা ধরে রেখে আগামী দিনে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব- এটাই হচ্ছে আমাদের অঙ্গীকার।
বৃহস্পতিবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস-২০২২ উপলক্ষে ‘টুঙ্গিপাড়া-হৃদয়ে পিতৃভূমি’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি এ আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জাতির পিতার জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উদ্যাপন করছি। উদ্যাপন করছি এই টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে। কারণ তাঁর জন্মস্থানে আমরা এই অনুষ্ঠানটি করতে চাই। জাতীয় শিশু দিবসকে স্মরণ করে তিনি বলেন, আজকের শিশু দিবস সফল হোক। এই শিশুর জন্য আমরা সুন্দর একটি ভবিষ্যত রেখে যেতে চাই। কারণ আজকের শিশুরা হবে আগামী দিনের কর্ণধার। শিশুদের ভবিষ্যত যাতে উজ্জ¦ল হয়, সুন্দর হয়- সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সকল কর্ম পরিকল্পনা।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ থেকে আবৃত্তি করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। তিনি বলেন, আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। আমরা অবশ্যই বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করব- এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার পরপরই আমাদের যে সংবিধান দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। শিশু অধিকার আইন সেসময় করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত ভালবাসতেন বলেই ২১ বছর পর যখন সরকার গঠন করি, তখনই ১৭ মার্চকে শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা দেই।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা এবং উত্তর গোপালগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শেখ মুনিয়া ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুজিববর্ষ উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীসভার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভা শেষে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও অন্য অতিথিদের সঙ্গে দর্শক সারিতে বসে প্রধানমন্ত্রী উপভোগ করেন ‘টুঙ্গিপাড়া-হৃদয়ে পিতৃভূমি’ শীর্ষক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অঙ্গীকার, সকল শিশুর সমান অধিকার’-প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় শিশু দিবস। জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং এরপর মুজিববর্ষের থিম সঙ্গ ‘টুঙ্গিপাড়া-হৃদয়ে পিতৃভূমি’ শীর্ষক একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা প্রদর্শিত হয়। দেশের বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় উপস্থাপন করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা রচিত গ্রন্থ ‘মুজিব আমার পিতা’ থেকে পাঠ করেন অভিনেত্রী তারিণ ও সহশিল্পীরা। বিজয়ী বরকতুল্লাহ আবৃত্তি করেন শেখ রেহানা রচিত কবিতা ‘বাবা’। এরপর বাবার তবলা আর মায়ের তানপুরার সঙ্গে ইসরাত জাহানের সারদ সৃষ্টি করে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের।
‘অমৃত সদনে চলো যাই’, ‘আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’, বিকশিত শিশু, আলোকিত ভবিষ্যত, শিশুদের চোখে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ, দেশবরেণ্য শিল্পীদের কণ্ঠে সমবেত সঙ্গীত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘যুদ্ধ হতো না এই দেশ স্বাধীন, এই সেই খোকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আজ জন্মদিন’ সঙ্গীত শিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের কণ্ঠে এ গানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সাংস্কৃতিক আয়াজন। পরে সন্তান ও ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত শিশু শিল্পীসহ অন্যদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠান শেষে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নানাদিক তুলে ধরে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে তিনি কেবল এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাত। আমি আর আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলাম। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে রিফিউজির মতো দেশ-বিদেশে আমাদের কাটাতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমি ফিরে এসেছিলাম। এমন একটি অবস্থায় যেখানে ঘাতক, যুদ্ধাপরাধী, আল-বদর, রাজাকারদের রাজত্ব ছিল। তবুও আমি ফিরে এসেছিলাম, আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। এদেশের শিশুদের যেন আগামী দিনে আমাদের মতো স্বজন হারার বেদনা নিয়ে বাঁচতে না হয়। তারা যেন সুন্দর জীবন পায়, উন্নত জীবন পায়, যে শিশুদের জাতির পিতা অত্যন্ত ভালবাসতেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের বিভিন্ন সময় শিশুদের অধিকার রক্ষায় সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, করোনার সময় স্কুল বন্ধ ছিল। এখন সব স্কুল খুলে গেছে। কাজেই এখন স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ আবার এসেছে। তারা পড়াশোনা করবে, সেটাই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। শিখনমূলক নানা ধরনের গ্রাফিক্স ও কার্টুন আমরা করেছি। যখন করোনা ছিল আমরা অনলাইনে ক্লাস নিয়েছি। শিশুরা যাতে বঞ্চিত না হয় সেদিকে ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করে দিচ্ছি। যেখানে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারবে।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শিশুরা সুরক্ষিত থাকবে, সুন্দর জীবন পাবে। জাতির পিতা এদেশের শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন। আমার ছেলে জয়ের (সজীব ওয়াজেদ জয়) সৌভাগ্য হয়েছে আমার বাবার কোলে চড়ে খেলা করতে। তিনি (বঙ্গবন্ধু) যখন বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতেন মনে হতো তিনি নিজেই যেন শিশু। এটাই ছিল তাঁর চরিত্রের সব থেকে বড় দিক।
আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির দুর্ভাগ্য, ’৭৫-এ শিশুরা মুক্তি পায়নি। কারবালার ময়দানেও এমন ঘটনা ঘটেনি। এই বাংলার মাটিতে যাদের জন্য আমার বাবা জীবন উৎসর্গ করেছেন, বছরের পর বছর কারাগারে ছিলেন, যাদের একটি জাতি হিসেবে মর্যাদা দিয়ে গেছেন, সেই বাঙালিদের হাতে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে দুঃখ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর শিশুদের জন্য বহু প্রাইমারী স্কুল জাতীয়করণসহ আমরা নানা ব্যবস্থা নিয়েছি। ২০০৮ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে শিশুদের সুরক্ষার জন্য জাতীয় শিশুশ্রম নীতি-২০০১, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ সুরক্ষা আইন-২০১০, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ সুরক্ষা আইন, ২০১০, জাতীয় শিশু নীতি- ২০১০, মাতৃদগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও ব্যবহার সরঞ্জামাদি বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করি।
তিনি বলেন, এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্ম-পরিকল্পনা (২০১৩-২০২৫) প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন-২০১৮, বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে জাতীয় পরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) প্রণয়ন করেছি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন-২০২০ প্রণয়ন করে নারী ও শিশুদের সার্বিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শতভাগ শিশুরা যাতে স্কুলে যায় সে ব্যবস্থা নিয়েছি। সাধারণ শিশুদের খেলাধুলাসহ নানা প্রতিযোগিতার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করে দিচ্ছি। শুরু থেকেই যাতে শিশুরা যাতে নানা ধরনের শিক্ষা পেতে পারে সেজন্য প্রাইমারী পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত আন্তঃস্কুল খেলাধুলার প্রতিযোগিতা ও সংস্কৃতি চর্চাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এভাবে শিশুদের জন্য বিভিন্ন কাজ আমরা করে যাচ্ছি।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য ২০৪১। ২০৭১ এ আমরা স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করব এবং ২১০০ সাল পর্যন্ত এ বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাও আমি করে দিয়ে গেছি। শিশুদের ভবিষ্যত যাতে উজ্জ্বল হয়, সুন্দর হয়- সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের সকল কর্ম-পরিকল্পনা। তিনি বলেন, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন শুরু করেছিলাম ২০২০ সালে। ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে আমরা জাতীয় শিশু দিবসটি উদযাপন করছি।
এ সময় আগামী ২১ থেকে ২৬ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় অনুষ্ঠিতব্য লোকজ মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এই টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে মুজিববর্ষ লোকজ মেলার আয়োজনের আইডিয়াটি এসেছে শেখ রেহানার চিন্তা থেকে। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি এ মেলার আয়োজন করছে। আগামী ২১-২৬ মার্চ পর্যন্ত টুঙ্গিপাড়ার সরকারী শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ মাঠে মেলা অনুষ্ঠিত হবে। চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে।
তিনি বলেন, আমাদের গ্রাম বাংলা নানা বৈচিত্র্যে ভরা। এই বৈচিত্র্যময় বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে এই মেলায় ঐতিহ্যবাহী লোকজ পণ্যের প্রদর্শনীসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে নানা ধরনের আয়োজন থাকবে। ওই সময় থাকতে পারব না বলে আমি আজ এই মেলার উদ্বোধন ঘোষণা করছি। আর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে একেকটা সংগঠন এই টুঙ্গিপাড়ায় আসবে। ১৮-২৫ মার্চ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ প্রত্যেককে আলাদা আলাদা তারিখ দেয়া হয়েছে। তারা টুঙ্গিপাড়ায় অনুষ্ঠান করবেন।