কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন/স্বাধীনতা তুমি/উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন/স্বাধীনতা তুমি/বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ…। বাঙালির মুক্তির ছবি আঁকা বোনের সেই মেহেদীর রংকে মুছে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠের নায্যতাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতার জোরে চির ধরাতে চেয়েছিল মায়ের শাড়ির আঁচলে। তবে শোষকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা বাঙালির বীরত্বে ভেস্তে গিয়েছিল বর্বর পাকিস্তানী জান্তা সরকারের সকল পরিকল্পনা। লাখো প্রাণের বিনিময়ে নয় মাস লড়াই শেষে এসেছিল কাক্সিক্ষত সেই স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত পর্বের সূচনাটা হয়েছিল মূলত অগ্নিঝরা মার্চ মাসে। তাই মার্চের প্রতিটি দিনের মাঝেই ছিল সার্বভৌম স্বদেশের প্রতিধ্বনি। ছিল মুক্তির বারতা।
একাত্তরের পাঁচই মার্চ ছিল শুক্রবার। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এদিনও চলছিল হরতাল। সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটার সেই হরতালের চিত্রটি চমৎকারভাবে উঠে এসেছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখায়। একাত্তরের দিনগুলি শিরোনামে বইয়ে রচিত ধারাভাষ্যে তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিব হরতালের দিনগুলোতে বেতন পাওয়ার সুবিধের জন্য এবং অতি জরুরী কার্যক্রম চালানোর জন্য সরকারী-বেসরকারী সব অফিস দুপুর আড়াইটা থেকে চারটা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। রেশন দোকানও ওই একই সময়ে খোলা। ব্যাংকও তাই। আড়াইটা-চারটার মধ্যে টাকা তোলা যাবে। তবে দেড় হাজার টাকার বেশি নয়। বিকেলে ব্যাংক খোলা- ভাবতেই মজা লাগছে। শেখের একেকটা নির্দেশে সব কেমন ওলট-পালট খেয়ে যাচ্ছে। জরুরী সার্ভিস হিসেবে হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, এ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তারের গাড়ি, সংবাদপত্র ও তাদের গাড়ি, পানি, বিদ্যুত, টেলিফোন, দমকল, মেথর ও আবর্জনা ফেলা ট্রাক- এগুলোকে হরতাল থেকে অব্যাহত দেয়া হয়েছে।
দিনটির আরেক রকম ধারাভাষ্য মেলে জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের একাত্তরের ডায়েরী নামের গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন- সকালে টঙ্গীতে মিলিটারি বেপরোয়া গুলি চালিয়ে লোক মেরেছে। ৯টায় শ্রমিকরা মিছিল করে শেখ মুজিবের বাড়িতে এসেছে। আগামীকাল শহীদ মিনারে মহিলারা বিক্ষোভ মিছিল করবেন আওয়ামী লীগ থেকে। আবার মহিলা পরিষদের প্রতিবাদ সভা বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হবে।
ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী, এদিন হরতাল পালনকালে সশস্ত্রবাহিনীর গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় চার শ্রমিক শহীদ হন এবং ২৫ শ্রমিক আহত হন। এ সংবাদে ঢাকাসহ সারাদেশের জনগণের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তাপমাখা সেই জনরোষের মুখে সন্ধ্যায় সরকারীভাবে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবার ঘোষণা দেয়া হয়।
ঐতিহাসিক মার্চের এইদিনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণাকে বেলুচিস্তান ন্যাপ অবাঞ্ছিত ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করে। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এদিন মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকেলে কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষকবৃন্দ মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের হয়।
এদিন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকেলে করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাত করেন। বৈঠক শেষে আসগর খান মন্তব্য করেন, সংখ্যাগুরু দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশের সংহতি রক্ষা করা অপরিহার্য। এদিকে মাওলানা গোলাম গাউস হাজারি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সকল নির্বাচিত সদস্যের পক্ষ থেকে ভুট্টোর কথা বলার অধিকার নেই। অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া কোন বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন পাক শাসকগোষ্ঠী এসব নেতার কারও বক্তব্যই গুরুত্ব দেয়নি। বরং পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, তা অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।
এদিন রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশী বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব জনাব ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসৎ উদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।