কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভাষা হাঁটছিল তার বর্ণমালাদের নিয়ে/শহরের বস্তি এলাকায়, গ্রামীণ রবি-শস্যের মাঠে/আর বানিয়া পাড়ার দীঘির পার ছুঁয়ে ছুঁয়ে …। এই কবিতার পঙ্ক্তিমালার সুর ধরেই ঢাকা থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে একই স্বরে উদ্দীপ্ত হয়েছিল নীলফামারী, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে সিলেটে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। প্রতিবাদের সেই বহ্নিশিখায় উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা শহর। সেই সুবাদে ৪ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলছিল ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ-দিবস পালনের প্রস্তুতি। অলি আহাদের এক লেখা থেকে জানা যায়, ৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ কর্মীশিবিরের ১৫০ মোগলটুলির কার্যালয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজনে ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে পতাকা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১২ ফেব্রুয়ারি কোন কর্মসূচী না থাকলেও টানা তিনদিন ধরেই চলে এ কর্মসূচী। এতে খুব বেশি অর্থ সংগ্রহ না হলেও পতাকা দিবসকে সামনে রেখে আরও নতুন নতুন কর্মী যুক্ত হতে থাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সে সময় ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নাদিরা বেগম ও ডাঃ সাফিয়াকে। তারা দুই বান্ধবী অন্যান্য ছাত্রীদের নিয়ে পোস্টার লেখার ব্যবস্থা করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভের প্রস্তুতি কেবল ঢাকা শহরে নয়, সমগ্র পূর্ব বাংলায় চলতে থাকে। ৫ ফেব্রুয়ারি নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের জরুরী অধিবেশন হয়। এতে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আপোসহীন সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ছাত্রসমাজের প্রতি আবেদন জানানো হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত তৎকালীন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ সমাবেশের সংবাদ পরিবেশিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত এসব কর্মসূচির প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট তারিখেরও উল্লেখ নেই। ইত্তেফাকে দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, বেশ কিছু স্থানে ধর্মঘট, বিক্ষোভের মতো কর্মসূচী নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রদের বেশ টানাপোড়েন চলে। মাদারীপুরের ছাত্রছাত্রীরা ধর্মঘট ও মিছিল করে। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয় ৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশেষ কারণে’ ধর্মঘট করতে না পেরে ৫ তারিখে ধর্মঘট আহ্বান করলে কর্তৃপক্ষ ওইদিন ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু প্রতিবাদী ছাত্রীরা পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি সাফল্যের সঙ্গে ধর্মঘট পালন করে। একুশের প্রস্তুতিকালের এই দিনগুলোতে বরিশালের রাজাপুর নিজামিয়া হাই স্কুলের ছাত্ররা কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে এ হামিদের সভাপতিত্বে সভা করে।
নীলফামারীতে হরতাল পালিত হয়। সাধারণ জনগণ ও ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহরে মিছিল করে। খয়রাত হোসেন, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, জবানউদ্দিন আহমদ মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন। ছাত্র জাকিউল আলমের সভাপতিত্বে বিরাট জনসভা হয়। খয়রাত হোসেন ছাড়া ছাত্রনেতা সুফিয়ার, এনায়েতুর রহমান, আনোয়ার, সুফিয়া, ফিরোজা বেগম ও রাহেলা বক্তৃতা করেন।
বায়ান্নর সেই সংগ্রামী সময়ে রংপুর স্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন ও শহরে মিছিল করে। জেলার ডোমারে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ধর্মঘট ও মিছিল করে। ৭ ফেব্রুয়ারি এ এলাকার ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালন করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয় এবং দোকানের ঝাপ জোর করে খুলে দেয়। কিন্তু তারপরও ব্যবসায়ীরা হরতাল পালন করে।
নারায়ণগঞ্জে ১০ ফেব্রুয়ারি রহমতুল্লা ক্লাবে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র প্রতিষ্ঠানের মিলিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের নির্দেশ অনুসারে এখানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এখানেও কর্মপরিষদ গঠিত হয়। শামসুজ্জোহা সভাপতি ও মফিজউদ্দিন আহমদ আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। পূর্ব-পাক ছাত্রলীগের সভাপতি ও শামসুল হক চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। আলমাস আলী, বজলুর রহমান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সিলেটেও জেলা রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়।