কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের সীমান্তে নারী ও শিশু পাচার, অস্ত্র, মাদক, ডলার, সোনা চোরাচালান, গরু পাচার, জাল নোট, জঙ্গি, সংঘবদ্ধ অপরাধী, সন্ত্রাসী তৎপরতাসহ সীমান্ত অপরাধ দমনে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। প্রতিবছর দেশের সীমান্তের চোরাই পথে চোরাচালানি মালামাল পাচার হচ্ছে সহ¯্রাধিক কোটি টাকার। বিশেষ করে গরু চোরাচালান এতই ভয়াবহ সমস্যা যে প্রায়শ: হতাহতের ঘটনা ঘটছে, যা বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশই বৈঠকে মিলিত হয়ে সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ও দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় সীমান্ত অপরাধসহ হত্যাকা- বন্ধসহ লেথাল আর্মস ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সীমান্তের অবৈধপথের চোরাচালান, পাচার, অনুপ্রবেশের মতো ঘৃণ্য অপরাধী কার্যক্রম কঠোর হস্তে দমন ও সতর্ক নজরদারি করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত অপরাধের ঘটনা ওপেন সিক্রেট। সীমান্তে চোরাই পথে গরু পাচারের ঘটনায় ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশই সীমান্তে হত্যাকা- বন্ধ, চোরাচালান, পাচার, অপরাধ দমনে কড়া নজরদারি, পাহারা জোরদার, সীমান্তরক্ষীদের নির্দেশ প্রদানসহ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উভয় দেশেরই দাবি। তারপরও মাঝে-মধ্যে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে, যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাই আন্তরিকতার কথা জানানো হয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যকার অনুষ্ঠিত বৈঠকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ-ভারত ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ। সীমান্তের ওপারে যারা থাকেন তাদের সঙ্গে এপারের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের ভাষা, সংস্কৃতিসহ নানা কাজে সু-সম্পর্ক থাকে। হয়তো মনের টানে নিজের অজান্তে অনেকে সীমানা অতিক্রম করে ফেলেন। হয়তো অনেকে যেটা করা উচিত নয় সেটাও করে ফেলেন। এজন্য মাঝে-মধ্যে দুই-একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়। আর সীমান্ত এলাকার অপরাধীরা সেই সুযোগে চোরাচালান, পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। এই ধরনের অপরাধ দমনে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ছাড়াও বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়াও র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) নিয়মিত জঙ্গি, সন্ত্রাসী, সংঘবদ্ধ অপরাধী, অস্ত্রধারী অপরাধী, মাদক, ডাকাতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজিবি-বিএসএফ এর বৈঠকের আলোচনায় সীমান্ত পাহারা জোরদার করা হয়েছে, চোরাচালান রোধে যৌথ অভিযান, পৃথক অভিযান চালানোর কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক আসছেই।
বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর সীমান্ত দিয়ে আসা চোরাচালান ও পাচার করা অস্ত্র, মাদক, গরু ও চোরাচালানি মালামাল উদ্ধার করার পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কোটি কোটি টাকার মাদক, অস্ত্র, ডলার, সোনা জব্দ করেছে বিজিবি। চোরাচালানের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তিন শতাধিক চোরাচালানি চক্রের সদস্যকে। সীমান্তপথের অবৈধ বাণিজ্যের প্রলোভনের টোপে পড়ে সীমান্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে অপরাধী চক্রের সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যথাক্রমে বিজিবি ও বিএসফ সদস্যদের চোখে ধুলো দিয়ে সীমান্তের হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যের কর্মকা- অব্যাহত রাখার খবর উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্তে সতর্ক নজরদারি ও কঠোর অবস্থান নেয়ার পরও সীমান্তরক্ষী ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিয়ে সীমান্তের অবৈধপথে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, পাচার হওয়ার মতো অপরাধের ঘটনা ঘটছে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে গরু নিয়ে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন ইদ্রিস, আসাদুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের গোড়ল ইউনিয়নের সেবকদাস গ্রামের বুড়িরহাট সীমান্তের ৯১৭ মেইন পিলারের অধীন পাঁচ নম্বর সাব-পিলার এলাকায় পৌঁছলে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সিতাই থানার গুনজরির চওড়া বিএসএফ ক্যাম্পের টহল দলের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। এ সময় ইদ্রিস ও আসাদুজ্জামান গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাদের লাশ সীমান্তের ভারতীয় অংশে পড়ে থাকে। নিহত দুজন হলেন কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের মালগাড়া গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে ইদ্রিস আলী (৪০) ও একই গ্রামের আলতাফ হোসেনের ছেলে আসাদুজ্জামান ভাসানি (৪৫)।
এর আগে ভারত থেকে গরু আনার সময় বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এরপর তারা মরদেহ নিয়ে ভারতে চলে যায়। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের বুড়িমারী বান্দেরমাথা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। নিহত দুই জন হলেন- ইউনুস আলী ও সাগর চন্দ্র। ইউনুস আলী পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের বাসিন্দা। সাগরের বাড়ি নীলফামারী জেলার জলঢাকা এলাকায়।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা বেনাপোলের পুটখালি ইউনিয়নের মহিষাডাঙ্গা গ্রাম থেকে অভিযান চালিয়ে ওয়ান শূটারগান ও কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে। এ সময় বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাকারবারিরা পালিয়ে যায়। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গুলি বেনাপোল পোর্ট থানায় সোপর্দ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বেনাপোল সীমান্তের কায়বা, রুদ্রপুর, গোগা, অগ্রভুলাট, পাঁচভুলাট, শালকোনা, পাকশিয়া, ডিহি, শিকারপুর,রামচন্দ্রপুর এবং পুটখালী, দৌলতপুর, গাতিপাড়া, সাদিপুর, রঘুনাথপুর, ঘিবা ও ধান্যখোলা সীমান্তের পাচারকারীরা বেশি সক্রিয়, যা খুবই উদ্বেগজনক। অস্ত্র মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ৩৭৮ জনকে আটক করে বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বেনাপোল সীমান্তের চোরাচালানিরা অনেকটা নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। দুই দেশের সীমান্ত ঘেঁষে এমনভাবে মানুষের বসবাস, শনাক্ত করা কঠিন কোনটা বাংলাদেশ আর কোনটা ভারত। এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে পাচারকারীরা সহজে এপার-ওপার যাতায়াত করে থাকে। তবে মাদক পাচার রোধে বিজিবি কঠোর থাকলেও অনেকটা উদাসীন ভারতের সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ সদস্যরা। এতে অনায়াসে মাদক দ্রব্যসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য অনায়াসে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এসব ঘটনার পর কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিজিবি।
শুধু বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই নয়, দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে মাদক ও চোরাচালান বিরোধী অভিযান চালিয়ে ভারতীয় বিপুল পরিমাণ গরুমোটাতাজাকরণ ট্যাবলেট, ফেনসিডিল, মদ, আতশবাজি ও প্রসাধনী সামগ্রী উদ্ধার করেছে বিজিবি। সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, শাড়িসহ চোরাচালানি মালামাল জব্দ করেন বিজিবি। ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় নারী ও শিশুসহ ৯ জনকে আটক করেছে বিজিবি। সম্প্রতি সলেমানপুর গ্রাম থেকে তাদের আটক করা হয়। মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে কিছু বাংলাদেশী ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে এমন গোপন সংবাদ পেয়ে সমেলমানপুর গ্রাম থেকে ২ পুরুষ, ৩ নারী ও ৪ জন শিশুকে আটক করা হয়। খুলনা বিভাগের ছয়টি সীমান্তবর্তী জেলার সীমান্ত এখনও অরক্ষিত। বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ চলছেই। ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই দালালের মাধ্যমে এই অনুপ্রবেশ করোনা মহামারীর সময় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম জেলার সঙ্গে ভারতের বিস্তীর্ণ সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তপথে বাংলাদেশীরা যেমন গবাদি পশু আনতে অবৈধ পথে ভারতে যাতায়াত করে, তেমনি ভারতীয়রা মাদকের চালান পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের ভেতরেও ঢুকে পড়ে। রাজশাহীর মাঝারদিয়াড়, খরচাকা, মধ্যচর, গোদাগাড়ী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা ও পোলাডাঙ্গা সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের নাগরিকরা একত্রে চাষাবাদ করেন। সীমান্তের অধিকাংশ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া না-থাকায় এপার-ওপারের বাসিন্দারা যাতায়াত করেন।
বিজিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে মাদকদ্রব্যসহ অবৈধ বিভিন্ন ধরনের মালামাল নিয়ে যাতে বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে চোরাকারবারিরা প্রবেশ করতে না পারে। সে ব্যাপারে সীমান্তে বিজিবি সব সময় কড়া নজরদারিসহ জোর টহল কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী-বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবি সীমান্তে দিন-রাত সমন্বিত টহল পরিচালনা করে উভয় দেশের চোরাকারবারিদের রুখে দেয়াসহ গ্রেফতারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন বিজিবি। বিজিবির কঠোর নজরদারির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজশাহীসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তপথে অনুপ্রবেশ ও নাগরিক চলাচল কমে এলেও তা এখনও শূন্যে নেমে আসেনি। ফলে মাঝে মাঝেই সীমান্তের অনুপ্রবেশ ও লোক চলাচলের ঘটনা ঘটে। কখনও কখনও বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিকের হতাহতের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা দেখা যায়। বিজিবি এসব কারণে সীমান্তে কঠোর নজরদারি করে থাকে। সরকারের শীর্ষ মহল থেকেও সীমান্তের অপরাধী কর্মকা- কঠোর হস্তে দমন ও কঠোর সতর্ক নজরদারি বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে বিজিবির দাবি।