শাবির ঘটনায় ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন, ৪৬৭ সাবেক শিক্ষার্থীর বিবৃতি, নিন্দা ॥ ভিসি পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল শাবি ॥ ক্যাম্পাস ছাড়ছে না শিক্ষার্থীরা

5
অবস্থানরত পুলিশদের ফুল দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ার অনুরোধ শিক্ষার্থীদের। ছবি- মামুন হোসেন

স্টাফ রিপোর্টার :
পুলিশী হামলার ঘটনা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে উত্তাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল (শাবি)। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রেখে সোমবার ১৭ জানুয়ারি সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছেন। এ সময় ভিসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দেয় শিক্ষার্থীরা।
সোমবার সন্ধ্যায় শাবি শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছে- উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তারা কিছুতেই আন্দোলন থামাবে না বা ক্যাম্পাস ছাড়বে না। সোমবার সারা রাত তারা ক্যাম্পাসে থাকবেন এবং রাত কাটাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে।
এদিকে, পরিস্থিতি সামাল দিতে আবার শাবি ক্যাম্পাসে পুলিশের বিশেষ বাহিনী ‘ক্রাইসিস রেন্সপন্স টিম’কে মোতায়েন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ পিপিএম।

ভিসির বাসভবনের সামনে পুলিশের অবস্থান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগ, হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত এবং ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাত থেকে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। গত শনিবার সন্ধ্যায় ছাত্রীদের কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠে। এরপর পরিস্থিতি পুরোপুরি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সোমবার দিনভর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে কয়েক দফায় বিক্ষোভ করেন। এ সময় ‘যেই ভিসি গ্রেনেড ছুঁড়ে, সেই ভিসির পদত্যাগ চাই’, ‘যেই ভিসি ছাত্র মারে, সেই ভিসি চাই না’, ‘যেই ভিসি গুলি ছুঁড়ে, সেই ভিসির পদত্যাগ চাই’, ‘শিক্ষার্থীর ওপর হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’, ‘সাস্টিয়ান সাস্টিয়ান এক হও এক হও’ শ্লোগানে ক্যাম্পাস উত্তাল করে তোলেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা একযোগে শাবির বঙ্গবন্ধু হল, সৈয়দ মুজতবা আলী হল, প্রথম ছাত্রী হল ও বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী (দ্বিতীয় ছাত্রী হল) হলে তালা লাগিয়ে দেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শাহপরান হলের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় শাবিপ্রবি প্রশাসনের কাউকেই হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে বিকেল সোয়া ৪টার উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করতে যান বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের বাধা দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা পুলিশ সদস্যদের ফুল দিতে দেখা যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরা শ্লোগান দিতে থাকেন- ‘পুলিশ তুমি ফুল নাও, আমার ক্যাম্পাস ছেড়ে দাও।’ পুলিশ ফুল না নেওয়ায় মাইকে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে খোলা চিঠি পাঠ করেন শিক্ষার্থীরা। চিঠিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা না দেয়া ও ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার আহবান জানানো হয়।
পুলিশকে ফুল দেয়া প্রসঙ্গে শিক্ষার্থী জোহরা আক্তার বলেন, ‘তারা আমাদের ক্যাম্পাসে অতিথি। তাই তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছি। আশা করি তারা ফুল নিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমরা কোনো পুলিশ চাই না।’ এরই স্মারক হিসেবে তারা পুলিশকে ফুল দিচ্ছেন।
এর আগে সোমবার দুপুরে বিভিন্ন হল থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী বেরিয়ে যান। তারা জানান, পরিস্থিতি যেভাবে ঘোলা হয়ে ওঠেছে, তাতে ভয় ও আতঙ্ক থেকে তারা হল ছাড়ছেন।
এদিকে, শাবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদারকে প্রধান করে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া (রাত ৭টা) পর্যন্ত কয়েক শ ছাত্র-ছাত্রী উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এবং মূল ফটকের সামনে আরও কিছু শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন।
অপরদিকে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের হামলায় আহতদের চিকিৎসা দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সোমবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, রবিবার ১৬ জানুয়ারি ক্যাম্পাসের ভেতরে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এতে চিকিৎসা জনিত যাবতীয় ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে।
শাবিপ্রবির ৪৬৭ সাবেক শিক্ষার্থীর বিবৃতি: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬৭ জন সাবেক শিক্ষার্থী।
সোমবার (১৭ জানুয়ারি) গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা সকলেই ইতোমধ্যে অবগত আছি যে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুন্নেসা হলের (মেয়েদের হল) শিক্ষার্থীরা হলের অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রভোস্টের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে গেলে তিনি উদ্ধত ও অশোভন আচরণ করে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলেন। প্রভোস্টের উন্নাসিক মন্তব্য ও আচরণে ক্ষিপ্ত শিক্ষার্থীরা হলের অব্যবস্থাপনা নিরসন, প্রভোস্টের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। গত ১৫ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কায়দায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডির উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ হামলা করে। শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে আনা হয়। প্রশাসনের নির্দেশে নৃশংস কায়দায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হামলায় কতজন আহত হয়েছেন তার সঠিক হিসাব এখনো জানা যায়নি। তবে শিক্ষার্থীদের ফেসবুক স্ট্যাটাস মারফত জানা যাচ্ছে যে, এখনো পুলিশ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করার জন্য খুঁজছে।
আমরা শাবিপ্রবির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এক প্রকার স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ্য করেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু হামলাই করেনি, তাদের ওপর জঘন্য কায়দায় শিক্ষক ও পুলিশের দিকে গুলি চালানোর মিথ্যা অপবাদও দিয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করার পাশাপাশি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের নৃশংস হামলার ত্ব্রী নিন্দা জানাই। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে আবার তাদেরকেই অভিযুক্ত করার মাধ্যমে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীদের রক্তে রঞ্জিত করে বর্তমান ভিসি, প্রক্টরসহ এই প্রশাসন এক ভয়াবহ অন্ধকার অধ্যায় রচনা করেছে। একটা প্রশাসন কতটা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীবিরোধী হতে পারে, তার এক কলঙ্কজনক নজির স্থাপন করল বর্তমান প্রশাসন। এই হামলার দায় একান্তই বর্তমান ভিসি, প্রক্টরসহ সমগ্র প্রশাসনের।
বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা মনে করি, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলা দূরে থাক, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে কোনোভাবে পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশই করতে পারে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ধারণার বিরোধী। একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে মুক্তাঙ্গন। যেখানে মত ও পথের স্বাধীন চলাচল থাকবে। দাবি দাওয়া উত্থাপন, সেই দাবি দাওয়া না মানলে আন্দোলনের মাধ্যমে মানতে বাধ্য করা এসবই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আন্দোলন করা, নিজেদের মতকে তুলে ধরা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার। পক্ষান্তরে যে কোনো ধরনের আন্দোলনে ছাত্রলীগের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন এবং পরিশেষে পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার মতো ন্যক্কারজনক কাজ প্রমাণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয় আদতে একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। এহেন পরিস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে জ্ঞানের তীর্থভূমি বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার কবর রচিত হয়ে ইট-পাথরের এক কঙ্কাল অবশিষ্ট আছে মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হওয়া, চলমান শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি আমরা শাবিপ্রবির প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ নিম্নোক্ত দাবি জানাচ্ছি: ১. অবিলম্বে শিক্ষার্থী পীড়নকারী ভিসি, প্রক্টর ও ছাত্রপরামর্শ ও নির্দেশনা পরিচালককে পদত্যাগ করতে হবে। ২. অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস ও হল বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহার করতে হবে। ৩. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার তদন্ত করতে হবে এবং আহত সকল শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও মানসিক আঘাত নিরাময়ের উদ্যোগ নিতে হবে। ৪. আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়াসমূহ পূর্ণ-দায়িত্ব সহকারে আমলে নিতে হবে এবং মানতে হবে। ৫. যেকোনো মূল্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিসর ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।