মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
বিজ্ঞান লেখক ও ব¬গার অভিজিৎ রায় হত্যাকান্ডে দন্ডিত পলাতক যে দুই জনের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে, তাদের একজনের বাড়ি মৌলভীবাজারে। দন্ডপ্রাপ্ত বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের বাড়ি মৌলভীবাজার সদরের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামে। তাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণার খবর শুনে বিস্মিত এলাকাবাসী। তবে জিয়ার গ্রামের বাড়ি তালাবদ্ধ। জিয়া কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কিনা জানেন না বাবা-মা।
২০১২ সালের জানুয়ারিতে যখন খবর প্রকাশ হয়, সরকার উৎখাত এবং সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় জড়িত সৈয়দ জিয়াউল হক, তখন তাকে নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল। এবার ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণার খবরে বিস্মিত হন এলাকাবাসী।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মোস্তফাপুর ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামে দন্ডপ্রাপ্ত মেজর জিয়ার পৈতৃক বাড়ি। বাবার নাম সৈয়দ জিল্লুল হক।
মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা, স্তব্ধ পুরো বাড়ি। জিয়ার পৈতৃক দুটি ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, কেয়ারটেকার নোমান আহমদ বসে আছেন। তিনি জিয়ার বসতভিটার পেছনে একটি ঘরে বসবাস করছেন। নোমানের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায়। তিনি রিকশাচালক।
নোমান আহমদ বলেন, ‘দীর্ঘ ১০ বছর ধরে মেজর জিয়ার বাড়ি দেখাশোনা করে যাচ্ছি। তার সঙ্গে কখনও আমার দেখা হয়নি। মেজরের বাবা সৈয়দ জিল্লুল হক মামার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমাকে বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জিল্লুল মামা ঢাকার বারিধারায় থাকেন। আগে তিনি ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন। পাঁচ বছর আগে একবার গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। এরপর আর আসেননি। কেন আসেন না, তাও বলেননি। আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা হয়। প্রতি মাসে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল পাঠিয়ে দেন।’
তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে কোনও দিন জিয়া সাহেবের দেখা হয়নি। মাঝে মধ্যে বাড়িতে পুলিশ এসে তার খোঁজ জানতে চায়। কোথায় আছে, কথা হয় কিনা এসব জানতে চায় পুলিশ। আমি তো তাকে চিনি না। দেখিনি কোনও দিন।’
সৈয়দ জিয়াউল হকের প্রতিবেশী জাবল আহমদ, মো. মতিন মিয়া ও আবুল হোসেন জানান, ‘১০ বছর ধরে এলাকায় আসেন না জিয়া। ২০১২ সাল থেকে শুনছি তাকে খুঁজছে পুলিশ। কোথায় আছেন জানি না। তার মা-বাবাও গ্রামের বাড়িতে আসেন না। জিয়ার বাবা-চাচা পাঁচ জন। এরমধ্যে জিয়ার বাবা ছাড়া বাকিরা লন্ডনে থাকেন। এখন তাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণার খবর শুনে আমরা বিস্মিত।’
প্রতিবেশীরা জানান, ‘জিয়ার বাবা-মা ঢাকায় থাকেন। একবার পুলিশ এসে বলেছিল, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ২০১২ সালে একদিন রাতে গ্রামে সেনাবাহিনী পরিচয়ে এক লোক এসে জানতে চেয়েছিল মেজর জিয়া কোথায় থাকেন, তার কোনও খোঁজ-খবর জানা আছে কিনা। আমরা জানিয়েছি, ২০১০ সালের পর থেকে গ্রামে আসা তো দূরের কথা, খোঁজও জানি না। তবে তার বাবা জিল্লুল হক বছর পাঁচেক আগে একবার বাড়িতে এসেছিলেন। জিয়ার বাবা-মা ছাড়া কেউ দেশে আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই।
প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সৈয়দ জিয়াউল হক মৌলভীবাজারের দি ফ্লাওয়ার্স কেজি অ্যান্ড হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে যান। ঢাকার উত্তরার হলি চাইল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাসের পর সিলেট ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা করেন। জিয়াউল হক তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। জিয়াউল হকের দুই বোন আছেন। জিয়ার প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার মামাতো বোন। তিনি ক্যানসারে মারা যান। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক পুত্রসন্তান আছে। পরে আবারও বিয়ে করেন পটুয়াখালীতে। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে দুই সন্তান আছে। কিন্তু তারা এখন কোথায় তা জানা যায়নি।
জিয়ার ঘরের পাশেই বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন চাচাতো ভাই সৈয়দ মুজাহিদ লিল্লা। তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে তার খোঁজ-খবর নেই। তার খবর আমরা রাখি না। কোথায় আছে, বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। তার বাবা পাঁচ-ছয় বছর ধরে বাড়িতে আসেন না। মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। বাড়ির জমিজমার খোঁজ নেন। এর বাইরে কোনও বিষয়ে কথা হয় না।’
মুজাহিদ লিল্লা বলেন, ‘জিয়ার আচার-আচরণ দেখে কোনও জঙ্গি সংগঠনের ঘৃণ্য কর্মকান্ডে জড়িত বলে আমাদের কারও মনে হয়নি। কিন্তু একের পর এক খবর শুনে এখন বিশ্বাস করতে হচ্ছে আমাদের।’
জিয়ার বাবা সৈয়দ জিল্লুল হকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন কেয়ারটেকার নোমান আহমদ। এরপর সাংবাদিক পরিচয় দিলে প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন জিল্লুল হক।
তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ৭২। আমার স্ত্রী বৃদ্ধ মানুষ। আমরা দুজনে অসুস্থ দীর্ঘদিন। এ জন্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না দীর্ঘদিন। বারিধারার বাসায় থাকি। আমার এক ছেলে, দুই মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে ঢাকায়।’
জিয়াউল হকের বিষয়ে জানতে চাইলে জিল্লুল হক বলেন, ‘জিয়ার বিষয়ে আমার চেয়ে আপনারা তো বেশি জানেন। তার সঙ্গে ১০ বছর ধরে আমাদের যোগাযোগ নেই। এমনকি তার স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গেও কথা হয় না। জিয়া কোথায় আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, আমরা জানি না। মায়ের সঙ্গেও কথা হয় না জিয়ার।
কোনও ধরনের চাপে কিংবা দুশ্চিন্তায় আছেন কিনা জানতে চাইলে জিল্লুল হক বলেন, ‘আমি অসুস্থ থাকায় কথা বলতে পারছি না। আমার স্ত্রী কারও সঙ্গে কথা বলে না। আপনি এখন রাখেন, সুস্থ হলে পরে কথা বলবো।’
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ গুরুতর আহত হন।
এ ঘটনায় অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছয় জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
২০১৯ সালের ৬ আগস্ট ছয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, জঙ্গি নেতা আকরাম হোসেনসহ পাঁচ জনকে মৃত্যুদন্ড দেন। সোমবার জিয়া ও আকরামকে ধরতে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।