কাজিরবাজার ডেস্ক :
একরকম তড়িঘড়ি করেই দেশে আজ থেকে শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের বুস্টার ডোজের প্রয়োগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে করোনাভাইরাসের বাড়তি টিকা মজুদ, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলানোসহ বিশ্বব্যাপী মাথাচাড়া দিয়ে উঠা ভাইরাসটির নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সতর্কতায় এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এর উদ্বোধন করবেন। প্রথম দিন ১ থেকে ২শ’ জনকে দেয়া হবে বুস্টার ডোজের টিকা।
কিন্তু কাকে, কিভাবে এবং ঠিক কতজনকে এই ডোজ দেয়া হবে তা বিস্তারিত জানে না খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। বুস্টার ডোজের টিকা পেতে হলে টিকাগ্রহীতাদের পুনরায় নিবন্ধন করতে হবে কিনাÑবা আগের নিবন্ধন অনুসারেই এসএমএস পাবেন তাও বলতে পারেননি অধিদফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তবে আইসিটি বিভাগ বলছে, টিকাগ্রহীতাদের বুস্টার ডোজের জন্য নতুন করে নিবন্ধনের দরকার পড়বে না। বয়স অনুসারে পূর্বের তালিকা অনুযায়ী এসএমএস পাঠালেই হবে। এক্ষেত্রে সুরক্ষা এ্যাপে ডোজ বাড়ানোর ঘর তৈরি করা হতে পারে।
এদিকে ইতোমধ্যে দুই ডোজ পাওয়া বয়স্ক এবং ফ্রন্টলাইনাররা কে কিভাবে বুস্টার ডোজের টিকা পাবে তার কোন সঠিক নির্দেশনা মিলেনি। অনেকেই এরকম পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
শনিবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, আজ রবিবার সকালে করোনার টিকার বুস্টার ডোজ প্রদান কার্যক্রম শুরু হবে। শুরুর দিকে বয়স্ক এবং ফ্রন্টলাইনাররা এই ডোজের টিকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবেন। পর্যায়ক্রমে টিকা গ্রহীতার সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বুস্টার ডোজে ফাইজারের টিকা দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী জানান, প্রথম দিন পরীক্ষামূলকভাবে এক থেকে ২শ’ জন মানুষকে টিকা দেয়া হতে পারে। এরপর পর্যায়ক্রমে সারাদেশেই বুস্টার ডোজ দেয়া হবে।
তবে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত কিছুই বলতে পারলেন না স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর ও ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব মোঃ শামসুল হক। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে একটা ছোট তালিকা করা হচ্ছে- কারা এই টিকা পাবেন। তবে কিভাবে এই তালিকা করা হচ্ছে এ বিষয়ে কিছু জানেন না উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, এখনও এসব বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। সিদ্ধান্ত আসলে আপনাদের জানিয়ে দেয়া হবে। বুস্টার ডোজের টিকাগ্রহীতাদের তাহলে নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে কিনাÑএ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আইসিটি বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা এখনও পাইনি। আপাতত আমরা ফাইজার দিয়ে শুরু করব। এটুকুই এখন বলতে পারছি।
এভাবে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই হুট করে এত বড় কর্মসূচী হাতে নেয়াকে অনেকটা তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত হিসেবেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, এখনও দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ সাধারণ মানুষ টিকার আওতায় আসেনি। এখন পর্যন্ত আমরা এক ডোজ টিকা দিতে পেরেছি ৫৩ শতাংশর কিছু বেশি। দুই ডোজ মানুষ টিকা পেয়েছে ২৭ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ। তাহলে আমরা কিভাবে তৃতীয় ডোজের কথা বলছি? আমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল একটা বড় পরিমাণ মানুষকে দুই ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসা। এটা না করে বুস্টার ডোজের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল। দেশের জনগণের একটা বড় অংশ যখন টিকার আওতার বাইরে তাহলে বুস্টার ডোজ দেয়া হবে কাকে, কেন? এখানে একটা বড় রকমের বৈষম্য তৈরি হয়ে গেল না? একটা অংশ টিকাই পেল না আরেকটা অংশকে তৃতীয় ডোজ দেয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। এরপর বলা হলো, বুস্টার ডোজে ফাইজারের টিকা দেয়া হবে। কিন্তু ফাইজারের টিকা পাওয়া দুই ডোজ মানুষের পরিমাণ খুবই কম। তাহলে অন্য কোম্পানির টিকা যারা নিয়েছে তাদের কোন টিকা দেয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই দেখছি টিকার কার্যক্রমে বড় ধরনের একটা অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। এখন যেহেতু টিকার প্রাপ্তি সহজ হয়েছে। দেশে টিকার মজুদও আছে পর্যাপ্ত, তাই আমি মনে করি, এর একটি সঠিক রোডম্যাপ জরুরী। পাশাপাশি টিকা নিতে অনীহা তৈরি হওয়া মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার জন্য সচেতনতা তৈরির কাজটাও শুরু করা দরকার বলে আমি মনে করি।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেহেতু বলেছে বুস্টার ডোজ ওমিক্রন প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকরÑতাই বুস্টার ডোজের সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে মনে করছেন অপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টি বি হাসাপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে ওমিক্রন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। বেশ কয়েকটি দেশে এটি প্রতিরোধে নেয়া হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে ওমিক্রন প্রতিরোধে বুস্টার ডোজ কার্যকরী। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও বুস্টার ডোজ শুরু করেছে। আমাদের যেহেতু টিকার মজুদ রয়েছে এবং প্রথম ডোজ, দ্বিতীয় ডোজ স্বাভাবিকভাবেই চলমান রয়েছে তাই বুস্টার ডোজ দিতে তো কোন সমস্যা নেই। এতে করে বয়স্ক মানুষজন আরও স্বস্থিতে থাকবে বলে আমি মনে করি।
এদিকে, বুস্টার ডোজের টিকা পেতে পুনরায় নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলেÑতথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরের সিস্টেমস ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেন, আমরা মনে করি না বুস্টার ডোজের জন্য নতুন করে বা পুনরায় নিবন্ধনের প্রয়োজন রয়েছে। আগে যারা নিবন্ধিত রয়েছেন তাদেরই বয়সের তালিকা ধরে এসএমএস পাঠালেই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে হয়তো টিকার ডোজের ঘরে তৃতীয় ডোজ নেয়া হয়েছে এমন একটা বাড়তি ঘর সংযোগ করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেহেতু পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করছে তাই তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। যা আপনাদের জানানো হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে যারা দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন, নির্দিষ্ট সময় পর তারা পাবেন তৃতীয় ডোজ। আর এ ডোজকেই বলা হচ্ছে বুস্টার ডোজ। তবে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার ঠিক কতদিন পর বুস্টার ডোজ নেয়া হবে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে যে টিকা দেয়া হয়েছিল সেটিই তৃতীয় ডোজ হিসেবে দেয়া হবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়।
ইতোমধ্যে দুই ডোজের টিকা পাওয়া ৬০ বছর বয়সী ফৌজিয়া বেগম বলেন, করোনার টিকা নেয়ার পরও সপরিবারে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তাই এতদিন যাবত অপেক্ষা ছিলাম বুস্টার ডোজ নেয়ার। এখন যদিও দেয়া শুরু হচ্ছে কিন্তু কিভাবে, কোথায় গেলে এ টিকা পাব কেউ বলতে পারছে না। প্রথম দিকে নিবন্ধন করার দুই মাসের মাথায় এসএমএস পেয়েছিলাম। এবার যদি আবার নিবন্ধন করতে হয় তাহলে তো ঝামেলাই হবে। বয়স হয়ে গেছে এখন কি আর এত ঝামেলা ভাল লাগে? তার চেয়ে যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগের নিবন্ধিতদের তালিকা ধরে ধরেই এসএমএস পাঠাতো তাইলেই সুবিধা হতো।
তবে এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দুই ডোজ পাওয়া এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, যদি ফাইজারের টিকাই বুস্টার ডোজ হিসেবে দেয়া হয় তাহলে আমরা পাব কিভাবে? গণমাধ্যমকর্মী হয়েও কোথাও এই তথ্য পাচ্ছি না।
তবে আজ এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে পারেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডাঃ রোবেদ আমীন। তিনি বলেন, বুস্টার ডোজ নিয়ে আগামীকাল (আজ) স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন রয়েছে। আশা করছি এখানে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় এবং এটি প্রতিরোধে চলতি বছরের জানুয়ারিতে টিকাদান কর্মসূচী শুরু হয়। মাঝখানে ভারত এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রফতানি বন্ধ করে দিলে টিকা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়লেও সরকারের নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে এটি পুনরায় গতিশীল হয়। দেশে এখন পর্যন্ত কত শতাংশ মানুষ করোনার টিকা পেয়েছেন এ বিষয়ে গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, দেশের প্রায় সাত কোটি মানুষকে করোনাভাইরাসের প্রথম ডোজ এবং প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষকে দুই ডোজ করে টিকা দেয়া হয়েছে। আর প্রায় পাঁচ কোটি টিকা এ মুহূর্তে সরকারের হাতে রয়েছে। আর তাই বুস্টার ডোজ কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। দেশে এ মূহূর্তে এ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্না ও সিনোভ্যাক টিকা দেয়া হচ্ছে।