পঞ্চাশ বছরেও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হয়নি

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আইনে বিচার সম্পন্ন করে সাজা কার্যকর করা হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তার সরকার স্বাধীনতার পর দালাল আইনে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু আইনী জটিলতার দোহাই দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্ত নষ্ট করে দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এভাবে বুুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত খুনীরা পার পেয়ে গেছে। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়নকারী আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনকে মামলায় আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মামলার পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় বিচারে তাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। তাও আবার ১৮ জন বুুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দায়ে সাজা হয়েছে মাত্র দুই জনের। এ কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার নেপথ্যে আইনী জটিলতার কথা বলছেন আইন বিশারদগণ। অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক কর্মকর্তা বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার ২৬ বছর পর আওয়ামী লীগ শাসনামলে ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় প্রথম মামলা করা হয়। ওই মামলায় আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে আসামি করা হয়। মামলাটি করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদের বোন ফরিদা বানু। ট্রাইব্যুনালের মামলায় তিনিও সাক্ষ্য দিয়েছেন ওই দু’জনের বিরুদ্ধে। মামলাটি পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিতে পাঠানো হয়। তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সিআইডির তৎকালীন সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমানকে (বর্তমানে অবসরে)। তিনি মামলার তদন্ত পর্যায়ে ১৯৯৮ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা দায়েরের জন্য অনুমতি চান। তদন্ত চলাকালে তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়-স্বজনসহ ৪০ জনের সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলাটি নতুন করে দায়েরের জন্য সিআইডিকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়। পরে ওই আইনে মামলা করার জন্য রমনা থানার মামলাটিতে আইনগত ভুল বলে উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা করার অনুমতি চেয়ে পুরো প্রক্রিয়া জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০০২ সালের ২০ আগষ্ট পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানো হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছিল ২০০২ সালে। তখন জানানো হয়েছিল, চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়ার পর ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা করা হবে। এরপর এ মামলাটি তদন্ত সংস্থা তদন্ত শুরু করে।
প্রথম মামলার এজাহারের বর্ণনা : তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২০ (খ)/৪৪৮/৩৬৪/ ৩০২/২০১/ ৩৪/ ১১৪ ধারা মতে শহীদ গিয়াসউদ্দীনের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের প্রধান হন্তারক বলে অভিযুক্ত আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামানকে। রমনা থানায় করা ওই বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার বাদী ফরিদা বানু বর্ণনা দেন সে হত্যাকান্ডের। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন, তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও মহসিন হলের হাউস টিউটর ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঘাতকরা মহসিন হল সংলগ্ন বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে হলের দিকে যায়। হলের সামনে তাকে পেয়ে দারোয়ান আবদুর রহিমের গামছা নিয়ে চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির কাদামাখা একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। ঘাতকরা অন্য হাউস টিউটরের বাসায়ও যায়। এ সময় ওই হলের ছাত্র ছিলেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। পরে তারা জানতে পারেন, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ড. মোঃ মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সিরাজুল হক ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ আরও অনেককে ধরে নিয়ে গেছে আলবদররা। শহীদ বুদ্ধিজীবী মোঃ মুর্তজার স্ত্রী ও সিরাজুল হকের ছেলে এনামুল হক অপহরণকারীদের দু’জনকে চিনতে পারেন। তারা হলেন চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান। দুজনই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে আশরাফুজ্জামান তৎকালীন অবজারভারে ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিন পূর্বদেশে সাংবাদিকতা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর ফরিদা বানু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছেড়ে আজিমপুরের ভাড়া বাসায় চলে যান। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তিনি তার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ড. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর গলিত মরদেহ দেখতে পান। ৫ জানুয়ারি মিরপুরের বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছ থেকে তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদের গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঘাতকরা হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ বুদ্ধিজীবীদের। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের নানা আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের নানা উদ্যোগ-আয়োজন সত্ত্বেও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার সম্পন্ন হতে পারেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘাতকদের বিচারের উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠিত হয় বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭২। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত ও বিচারেরও প্রথম দাবি করা হয় ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ। শহীদুল্লাহ কায়সার, ডাঃ আলীম চৌধুরী, জহির রায়হান, আজহারুল হক প্রমুখ শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যার তদন্ত দাবি করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করা হয়। এরপর সমাবেশটি মিছিলসহ পুরনো গণভবনে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে। ১৮ মার্চ দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, বঙ্গবন্ধু শহীদ পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শহীদ জহির রায়হানের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে বলেন, তিনি হত্যা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হবে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনটি আর কখনই প্রকাশ হয়নি।
দালাল আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠন : ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সরকারী প্রেসনোটের মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা জানানো হয়। একই সঙ্গে দালাল আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়। প্রবর্তন করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট’১৯৭৩। এ আইনের আওতায় সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ঢাকাতেই ছিল ১১টি। ওই আইনেই শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী অপহরণ মামলায় ১৯৭৩ সালের ৩০ জুন দুজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এ কে এম আজাদ হত্যা মামলায় তিনজন আলবদরের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে অপহরণ করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ঢাকার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জামিল ওরফে জামাল এবং খালিদ আহমেদ নামে দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ওই বিচারের রায় কার্যকর করার কোন খবর পাওয়া যায়নি। বরং, দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াই বন্ধ করে দেয় পরবর্তী সরকার।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলা নষ্ট করে দেয় : ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় দায়ের করা প্রথম মামলাটি হওয়ার পর তা নষ্ট করে দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলাটি শেষ করে দিতে আইনগত ভুল বলে দাবি করে ২০০২ সালের ২০ আগষ্ট প্রথমে মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়। পরে পুলিশের সিআইডি থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুসারে মামলা হতে পারে কি না তা জানতে চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী তা ফাইলচাপা দিয়ে রাখেন। এখনও সে চিঠির ব্যাপারে কোন নির্দেশনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের কাছে আসেনি বলে জানা গেছে।
ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়নি : শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরুর পর ওই মামলাটিই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। আর সম্প্রতি সে মামলায়ই সম্পন্ন হলো দুই প্রধান খুনী বলে অভিযুক্ত চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিচার। মানবতা বিরোধী অপরাধে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ তথা যুদ্ধাপরাধ আইনের আওতায় বুদ্ধিজীবীদের খুনী বলে অভিযুক্ত দুজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত এ দুজনের বিরুদ্ধে একটি মামলায়ই বিচার সম্পন্ন হলো। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আলবদর বাহিনীর চীফ এক্সিকিউটর বা ‘প্রধান জল্লাদ’ ছিল আশরাফুজ্জামান খান আর অপারেশন ইনচার্জ ছিল চৌধুরী মাঈনুদ্দীন। তারা দুজন অভিযুক্ত হয়েছে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যার দায়ে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট’৭৩’র ৩/২ ধারা অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা- এ ৫ ধরনের ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের পাকিস্তানের সভাপতি হিসেবে মতিউর রহমান নিজামী আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান এবং ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তানের সভাপতি হিসেবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয় এবং এর সদস্যরা ওই বাহিনীর সদস্য হিসেবে নৃশংসতম ঘাতকের ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধাপরাধ আইনেই বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার : ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও ষড়যন্ত্রসহ অনেক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে যুদ্ধাপরাধ আইনানুযায়ী যুদ্ধকালীন সময়ে এ ধরনের যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার চলছে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনে। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন পাস হয় এবং এ আইনটি কয়েক দফা সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের যেহেতু যুদ্ধের সময়ে হত্যা করা হয়েছে সেহেতু তাদের বিচারও এ আইনের আওতায় হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানিয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সারাদেশে মোট ৯৬৮ জন শিক্ষাবিদ, ২১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং ৪১ জন আইনজীবীসহ ১০২০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদারদের এ দেশীয় দোসর আলবদর বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। এটি ছিল সম্ভাব্য স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশকে বুদ্ধিভিত্তিকভাবে পঙ্গু করে রাখতে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। পর্যায়ক্রমে সব বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারই যুদ্ধাপরাধ আইনে হবে বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে।
১৮ বুদ্ধিজীবী হত্যায় অভিযুক্ত দুজন : শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই মূল খুনী বলে অভিযুক্ত হয় আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের ঊষালগ্নে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে তাদের দুজনকে একসঙ্গে অভিযুক্ত করে একটি মামলায় বিচার হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও ৩ জন চিকিৎসক। যে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার জন্য আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিন অভিযুক্ত হয় তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকরা হচ্ছেন, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহি, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। শহীদ চিকিৎসকরা হচ্ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ মোঃ মর্তুজা, বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আব্দুল আলীম চৌধুরী ও বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ ফজলে রাব্বী। শহীদ সাংবাদিকরা হচ্ছেন, দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেন, পিপিআইয়ের চীফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের চীফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সংবাদদাতা ও পিপিআইয়ের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নিজামউদ্দিন আহমেদ, শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা সেলিনা পারভীন এবং দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার।
অভিযোগে বলা হয়, এ দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরাসরি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা হাইকমান্ডের নির্দেশে আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করে। আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং চীফ এক্সিকিউটর মোঃ আশরাফুজ্জামান খানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- সংঘটিত হয়। তাদের নেতৃত্বে আলবদরের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে অপহরণ করে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলবদর হেডকোয়ার্টারের নির্যাতন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। তারপর মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে মরদেহ ফেলে দেয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়, একাত্তর সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন এবং পিপিআইয়ের চীফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হককে তাদের বাসা থেকে অপহরণ করা হয়। ১১ ডিসেম্বর ভোর রাতে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার চীফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ১২ ডিসেম্বর বিবিসির সংবাদদাতা ও সাবেক পিপিআইয়ের জেনারেল ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন আহমদ, ১৩ ডিসেম্বর তারিখে দৈনিক শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা সেলিনা পারভীন এবং ১৪ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণ করা হয়। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহি, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডাঃ মোহাম্মদ মর্তুজাকে অপহরণ করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডাঃ আলিম চৌধুরী এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ ফজলে রাব্বীকে অপহরণ এবং নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। অপহৃত সাংবাদিকদের মধ্যে সেলিনা পারভীনের অর্ধগলিত লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে একাত্তর সালের ১৮ ডিসেম্বর পাওয়া যায়। অন্য সাংবাদিকদের মরদেহের হদিস পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে সন্ধান করতে গিয়ে বাহাত্তর সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর বিহারি ক্যাম্পে গিয়ে নিখোঁজ ও শহীদ হন তার ভাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক জহির রায়হান।
১৯৭১-এর ৯ মাসে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল ‘শান্তি কমিটি’, ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’, ‘মুজাহিদ বাহিনী’ ইত্যাদি ঘাতক বাহিনী গঠন করে বাংলাদেশে ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। সরকারী হিসেবে ২ লাখ, বেসরকারী হিসেবে ৫ লক্ষাধিক নারী তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১ কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রাণরক্ষার জন্য প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে ভীতসন্ত্রস্ত জীবনযাপন করেছেন আরও দুই কোটি মানুষ। পরাজয় নিশ্চিত জেনে স্বাধীনতার ঊষা লগ্নে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর দলীয় ঘাতক বাহিনী ‘আলবদর’ এই বুদ্ধিজীবী হত্যা কার্যকর করেছিল। এর নীলনক্সা প্রণয়ন করেছিল জামায়াতের শীর্ষ নেতারা।