স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটে মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে খুন হওয়া রায়হান আহমদ (৩৪) হত্যার দায়েরকৃত মামলার অন্যতম পলাতক আসামী আব্দুল্লাহ আল নোমানের মালামাল ক্রোকী পরোয়ানার শুনানির দিন ধার্য ছিলো রবিবার ৫ ডিসেম্বর।গতকাল সিলেট অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন আদালতে জারিকৃত ক্রোকী পরোয়ানা তামিল হয়ে না আসায় পরবর্তী শুনানীর দিন ধার্য করেন আদালত।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন নিহত রায়হানের আইনজীবী ব্যরিস্টার এমএ ফজল চৌধুরী। তিনি জানান, রায়হান হত্যা মামলার অন্যতম আসামী কোম্পানীগঞ্জের আব্দুল্লাহ আল নোমান ঘটনার পর সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। পলাতক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, মালামাল ক্রোকী পরোয়ানা জারি করেন আদালত। রবিবার আদালতে ক্রোকী পরোয়ানা তামিল হয়ে ফেরৎ না আসায় আদালত পুনরায় আরেকটি ধার্য তারিখ নির্ধারণ করেছেন।
রায়হান হত্যা মামলার সাক্ষি চুলাই লালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে চুলাই লাল কিভাবে মারা গেছে সেটা দেখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এটা আমাদের কোন বিষয় নয়।
এদিকে, রায়হান আহমদ হত্যা মামলার ঘটনার অন্যতম সাক্ষী চুলাই লাল আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছেন রায়হানের মা সালমা বেগম। এছাড়া আরেক সাক্ষী হাসানকে সাক্ষ্য না দিতে ‘হুমকি’ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। গতকাল রবিবার রায়হান হত্যা মামলার শুনানিতে আদালতে উপস্থিত হন তার মা সালমা বেগম। সেখানে অপেক্ষামান সাংবাদিকদের কাছে তিনি এমন অভিযোগ করেন। সালমা বেগম বলেন, ‘রায়হানকে কাষ্টঘরের চুলাই লালের ঘর থেকে সুস্থভাবে ধরে আনে পুলিশ। পরে তাকে মারধর করা হয়। চুলাই লাল হলো প্রথম সাক্ষী। সে নাকি দুই মাস আগে মারা গেছে। এখন আমি শুনছি, কেউ কেউ বলছে, পুলিশও বলছে, সে নাকি আত্মহত্যা করেছে। আমি সঠিক জানি না সে আত্মহত্যা করেছে কিনা বা সে কিভাবে মারা গেছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার আরেকটা সাক্ষী, যে পাশের কুদরতউল্লাহ মার্কেটের দুতলা থেকে, হাসান (সাক্ষী) নামের একজন বলেছিল, সারারাত আমার রায়হান যে কাঁদছিল, চিৎকার করছিল সে নিজের কানে শুনেছে। সকালে সে আমাদেরকে জানিয়েছিল যে, রায়হান মারা গেছে। সে এখন ঢাকায় আছে। তাকেও এখন হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কে বা কারা হুমকি দিচ্ছে?’ বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির একেবারে লাগোয়া হচ্ছে কুদরতউল্লাহ মার্কেট। রায়হানের মা বলেন, ‘(হাসানকে) হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে, তুমি কোথায় আছো? তুমি সাক্ষী দিতে যাবে না। নানা রকম হুমকি দিচ্ছে। কে বা কারা হুমকি দিচ্ছে, সে জানে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই যে দুজন সাক্ষী, প্রথম দুইজন, একজন তো মারাই গেল…কিভাবে মারা গেলে আমি জানি না। আর হাসানকেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এখন তো আমি মনে করি, আমারও এখন নিরাপত্তা নাই। আমাদের কারোরই নিরাপত্তা নাই। তারা (আসামিরা) জেলে থেকে যেভাবে হুমকি দিচ্ছে, আমি তো মনে করি, তারা জেলে থাকলেও তাদের প্রভাব তারা ঠিকই খাটাচ্ছে।’ সালমা বেগম বলেন, ‘এরা যদি জেল থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে আরো কতো রায়হান মারা যাবে! যাতে আর কোনো রায়হান মারা না যায়, সেজন্য এদেরকে ফাঁসির আওতায় আনতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর মধ্যরাতে নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে রায়হান আহমদকে নির্যাতন করা হয়। ১১ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রীর করা মামলার পর মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়। ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৪ জনকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত ও ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর পুলিশি হেফাজত থেকে কনস্টেবল হারুনসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে প্রধান অভিযুক্ত আকবর ১৩ অক্টোবর পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
ময়না তদন্তের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহত রায়হানের মরদেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এসব আঘাতের ৯৭টি ফোলা আঘাত ও ১৪টি ছিল গুরুতর জখমের চিহ্ন। এসব আঘাতগুলো লাঠি দ্বারাই করা হয়েছে। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।
আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৫ মে আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই (সাময়িক বরখাস্ত) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে (৩২) প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হচ্ছে, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী (৪৩), কনস্টেবল মো. হারুন অর রশিদ (৩২), টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), ফাঁড়ির ‘টুইআইসি’ (সেকেন্ড-ইন-কমান্ড) পদে থাকা সাময়িক বরখাস্ত এসআই মো. হাসান উদ্দিন (৩২) ও এসআই আকবরের আত্মীয় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল নোমান (৩২)। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ আল নোমান পলাতক থাকলেও অপর সকল আসামীরা কারাগারে রয়েছে।