বিজয়ের মাস

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালির অহঙ্কার বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি তার আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও স্বাধীন পতাকা পেয়েছিল যে মাসে, তার নাম ডিসেম্বর। তবে এবার বিজয়ের মাস এসেছে এক অনন্য গৌরবময় উজ্জ্বলতা নিয়ে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ৫০ বছরপূর্তি, সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস-আনন্দে মাতোয়ারা হবে গোটা বাঙালি জাতি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশজুড়ে চলমান ‘মুজিববর্ষ’-এর মধ্যেই শুরু হলো বাঙালির কাক্সিক্ষত মুক্তিসংগ্রামে বিজয় অর্জনের মাস ডিসেম্বর। আর মাত্র কয়েকটা দিন। ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ হবে বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর, সুবর্ণজয়ন্তী। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে চারদিকে বর্ণিল আয়োজন, সাজ সাজ রব।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছর উপলক্ষে ৫০ জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে এক অন্যরকম নবজাগরণের সৃষ্টি করবে দেশজুড়ে। কিছু চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসররা ছাড়া পুরো কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতিই উৎসবে-আনন্দে মাতোয়ারা হবেন, হৃদয়ের অঞ্জলি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মহার্ঘ স্বাধীনতা।
মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজারো বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও ভূখ-ের স্বীকৃতি আদায়ের মাস। ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষণকে পদানত করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল সন্তানরা ছিনিয়ে আনা বীরত্বগাঁথা বিজয় অর্জনের মাস।
৫০ বছর আগের ২ ডিসেম্বর। একাত্তরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর যতই এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেন ততই এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে হিংস্র পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী তার রাজাকার, আলবদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারদিকে ছড়িয়ে দেয় নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাতে। কিন্তু তখনও হানাদার বাহিনী বুঝতে পারেনি তাদের পতন অত্যাসন্ন।
একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয়রথে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। পরাজয়ের আভাস পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন মরিয়া হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি চিঠি পাঠান। ইয়াহিয়া তার চিঠিতে যুদ্ধকালীন সাহায্যের আশায় ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এক অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সীমান্ত এলাকায় পাক জান্তারা সমরসজ্জা বৃদ্ধি করায় ভারতও তা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়।
ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ত্রিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এসব দেখেশুনে ভারত সরকার বুঝেছিল, পাকিস্তান যুদ্ধ করবেই। ভারত তখন যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা বা আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সামরিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমের প্রস্তুতি দেখে এবং নাশকতামূলক কাজের লোক ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত মোটামুটি পরিষ্কার বুঝে ফেলে পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে না, বরং লড়াই-ই করবে। তাই তখন থেকে ভারতের প্রস্তুতিও জোরদার হয়েছিল।
অন্যদিকে বীর বাঙালির গেরিলা আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে পাক সৈন্যরা। যতই সময় গড়াচ্ছিল গেরিলা আক্রমণ ততই প্রবল হতে থাকে। পাক সেন্যদের হাতে তখনও আধুনিক অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পরাস্ত করতে থাকে। মুক্তিপাগল বাঙালীর অকুতোভয় লড়াইয়ে পাক হানাদারদের রাতে চলাফেরাও কঠিন হয়ে পড়ে। নিয়াজী বুঝতে পারে, এবার বড় ধরনের কিছু করতে না পারলেই নয়। তাই মার্কিন সাহায্য নিশ্চিত, নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি, রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ এ দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর জঘন্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকে কসাই নিয়াজী।
মহান এ বিজয়ের মাস উদযাপনে জাতীয় কর্মসূচীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। বিজয়ের মাসের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে স্বেচ্ছাসেবক লীগ শিখা চিরন্তনে শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোর মিছিল করেছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ১ ডিসেম্বর দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করেছে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাতীয় বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।