ওমিক্রন প্রতিরোধে সতর্ক অবস্থায় সারাদেশ ॥ বিমানবন্দর, স্থলবন্দরসহ সব প্রবেশ পথে কঠোর নজরদারি

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে এটির প্রবেশরোধে সারাদেশের এন্ট্রিপয়েন্টগুলোতে নেয়া হয়েছে সতর্কাবস্থা। শুধু তাই নয়, ভাইরাসটির দাপট যেন আবারও দেশের করোনা পরিস্থিতিকে ভয়ঙ্কর করে তুলতে না পারে তার জন্য জনসমাগম সীমিত-করণসহ ৪টি সুপারিশ করেছে করোনা প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে বিশেষ নির্দেশনা মানার কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সারাবিশ্ব আবারও করোনার তান্ডব প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। তবে এবার শত্রু ভাইরাসটির নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’। ভয়ঙ্কর এই ভ্যারিয়েন্টটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। আফ্রিকান এই ভ্যারিয়েন্টটি রোধে ইতোমধ্যে বিশ্বের কয়েকটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশেও ভাইরাসটির প্রবেশরোধে নেয়া হচ্ছে কঠোর ব্যবস্থা।
শুধু তাই নয় ওমিক্রন প্রতিরোধে করণীয় ঠিক করতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিতব্য ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ এ্যাসেম্বলি সেকেন্ড স্পেশাল সেশন’ এ অংশ নিতে যাত্রা করলেও মাঝপথে গিয়ে ফিরে এসেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের মতো ওমিক্রন প্রতিরোধেও সফল হবে দেশ।
রবিবার সরকারের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৪৮তম সভায় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর বিস্তার রোধ করার জন্য এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশ, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ সে অঞ্চলের কয়েকটি দেশ (জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, বোতসোয়ানা, সোয়াজিল্যান্ড, ইসরাইল, হংকং) থেকে যাত্রী আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফ্লাইটসহ)। তাই বাংলাদেশে এটি প্রবেশে তাদের চারটি সুপারিশগুলো বাংলাদেশেও এসব দেশ এবং যেসব দেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে সেসব দেশ থেকে যাত্রী আগমন বন্ধ করা, কোন ব্যক্তির এসব দেশে ভ্রমণের সাম্প্রতিক (বিগত ১৪ দিনে) ইতিহাস থাকলে তাদের বাংলাদেশে ১৪ দিন ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। কোভিড-১৯ এর টেস্ট পজিটিভ হলে আইসোলেশন করতে হবে। প্রতিটি পোর্ট অব এন্ট্রিতে স্ক্রিনিং পরীক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত ব্যবস্থা আরও কঠোরভাবে পালন করা (স্কুল কলেজসহ), চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা ও বিভিন্ন (রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়) সমাবেশে জনসমাগম সীমিত করা, কোভিড-১৯ এর পরীক্ষায় জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য বিনামূল্যে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা।
এদিকে ভাইরাসটির নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট রোধে সারাদেশের বিমান, সমুদ্র ও স্থলবন্দরসহ সব পোর্ট অব এন্ট্রিতে সতর্কবার্তা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। একইসঙ্গে সবাইকে নিয়মিত মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়াসহ ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রবিবার দুপুরে দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে অধিদফতরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা সবাই জেনেছি ‘ওমিক্রন’ নামক দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উৎপন্ন করোনার একটি নতুন ভ্যারিয়েন্টকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বে¦র বিভিন্ন দেশ প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমাদের সব পোর্ট অব এন্ট্রিতে নির্দেশনা দিয়েছি। তিনি বলেন, জাতীয় কারিগরি কমিটি, ন্যাশনাল ইমুনাইজেশন টেকনিক্যাল কমিটিসহ (নাইট্যাগ) স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সভা করছেন। তারা বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সবার নিরাপত্তা দেয়ার জন্য যেসব কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হয় সেগুলো আমরা নেব। আমরা সবার সহযোগিতা নিয়ে এটি মোকাবেলা করতে চাই, করোনা মোকাবেলা করতে চাই।
সতর্ক বার্তায় তিনি আরও বলেন, কোন অবস্থাতেই আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন সুযোগ নেই। যে কোন সময়েই সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। তাই সংক্রমণ মোকাবেলায় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি ও শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। নাক-মুখ ঢেকে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরতে হবে এবং নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড বা তারচেয়ে বেশি সময় হাত ধুতে হবে।
দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতির তথ্য উল্লেখ করে এ মুখপাত্র বলেন, গত এক সপ্তাহে আমরা যদি দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি দেখি, এক লাখ ২৫ হাজার ৫৮৫টি পরীক্ষা গত সাতদিনে হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সপ্তাহের চেয়ে তিন শতাংশের মতো কম। আর এই সাতদিনে এক হাজার ৬৯০ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সাতদিনের চেয়ে চার দশমিক ৯০ শতাংশ বেশি। একইসঙ্গে গত সাতদিনে দেশে ২৯টি মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সাতদিনের চেয়ে একটি বেশি। তিনি আরও বলেন, সামগ্রিকভাবে বিগত সাতদিনের যে সংক্রমণ পরিস্থিতি, সেটি শতকরা শনাক্তের হিসাবে দুই শতাংশের নিচে আছে।
বন্দর পরিস্থিতি উল্লেখ করে নাজমুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে বিমান, সমুদ্র ও স্থলবন্দরগুলো দিয়ে সর্বমোট নয় হাজার ৫৯০ জন যাত্রী দেশে প্রবেশ করেছে। আর তার সিংহভাগই এসেছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। তাদের প্রত্যেককেই যথাযথ স্ক্রিনিং করার পর প্রয়োজন অনুযায়ী আইসোলেশন বা যাদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর প্রয়োজন তাদের আমরা পাঠিয়েছি। আমরা মনে করি, করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি আমাদের মেনে চলতেই হবে।
এদিকে করোনার দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ানোর কারণে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। করোনার এই নতুন সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সরকারী সফরে সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেও মাঝপথ থেকে দেশে ফিরে এসেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বিশ্বব্যাপী আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং এ বিষয়ে জরুরী নির্দেশনা ও করণীয় ঠিক করতে শনিবারই দুবাই থেকেই দেশে ফিরে এসেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি খুব দ্রুতই দেশে ওমিক্রন মোকাবেলা করার বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে জরুরী বৈঠক করবেন এবং বৈঠক শেষে সেদিনই মিডিয়া ব্রিফ করে স্বাস্থ্যখাতের প্রস্তুতির বিষয়টি দেশবাসীকে অবগত করবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকান নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি এবং এই ভাইরাসটি খুবই এ্যাগ্রেসিভ। সে কারণে আফ্রিকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ এখন স্থগিত করা হচ্ছে। সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দর বা দেশের সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং আরও জোরদার করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সারাদেশেই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে বিশেষ করে মুখে মাস্ক পরায় উদ্বুদ্ধ করতে সব জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।
এর আগে গত শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানায় শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে জরুরী বৈঠক ডাকে। বৈঠকে নতুন ভ্যারিয়েন্টটির নামকরণ করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরনের নাম রাখা হয়েছে ‘ওমিক্রন’। প্রাথমিকভাবে এটিকে বি.১.১.৫২৯ নামে ডাকা হচ্ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ধরনটিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
তাই দেশে করোনার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোর প্রবেশপথে আবারও স্ক্রিনিং কার্যক্রম জোরদার করার আহবান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা করোনার ভয়ঙ্কর সময় পার করেছি সফলভাবে। এখন সংক্রমণ অনেকটা কমে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে একটা উদাসীন ভাব দেখা দিয়েছে। কিন্তু করোনা তো চলে যায়নি। এটি নানান সময়ে নানান রূপে ফিরে আসছে। তাই আমাদের সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। মাস্ক, হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহারের অভ্যাসটা চালু রাখতে হবে। তবে ওমিক্রন প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে দেশের এন্ট্রি পোর্টগুলোতে। বিশেষ করে বিমানবন্দরগুলোতে। ওমিক্রন শনাক্ত হওয়া দেশগুলো থেকে যদি কোন যাত্রী বাংলাদেশে আসে তাদের অবশ্যই কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। কেউ যদি করোনা পজিটিভ হয় তাহলে তার আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। তবে যেকোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদের করোনা ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে। আতঙ্কের কোন কারণ নাই। আমরা দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত।