যুগে যুগে মতভিন্নতার ধরন, প্রকৃতি এবং তার প্রতিকার

52

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

দীনের ব্যবহারিক অনেক বিষয়ে শরয়ী দলীলের ভিত্তিতে মুজতাহিদ ইমামগণ পরস্পর ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। এ কারণ, কখনো তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য, কখনো দলীলের দ্ব্যর্থকতা বা প্রচ্ছন্নতা, কখনো তাঁদের দলীল সংক্রান্ত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। উপরন্ত, তাঁদের উপরন্ত, তাঁদের এ মতভিন্নতা কখনো বাহ্যিক ও শাব্দিক হয়ে থাকে; কখনো তা ‘আমালের স্বরূপ নির্ণয় কেন্দ্রিক হয়ে থাকে, কখনো তার পরস্পর বিরোধীও হয়ে যায়। আবার কখনো এ ভিন্নতা কেবল আমলের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে; বিধান পর্যন্ত গড়ায় না। দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ও বুদ্ধি-বিবেকগত তারতম্যের কারণে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে যে মতভিন্নতা দেখা দেয়, তা আল্লাহর তা‘আলার সৃষ্টি নৈপুণ্যের একটি নিদর্শন এবং স্বাভাবিক নিয়মেই তা তৈরি হয়। এরুপ মতভিন্নতা দূষণীয় নয়, যদি তা বিশুদ্ধ দলীল ও যুক্তিনির্ভর হয় এবং শিষ্টাচার ও নীতিবিবর্জিত না হয়। তদুপরি ক্ষেত্রেবিশেষ তা উপকারীও। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে ইখতিলাফের পরিচয়, ফিক্হী ইখতিলাফের বিধান ও বিভিন্ন প্রকরণ, বিভিন্ন যুগে ফিক্হী ইখতিলাফের ধরন, প্রকৃতি ও আদাব এবং ইমামগণের উদারনৈতিক ইখতিলাফের (মত পার্থক্যের) সুফল প্রভৃতি বিষয় বর্ণনামূলক ও অবরোহ পদ্ধতিতে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
‘ইখতিলাফ’ শব্দটি আরবী। এর প্রকৃত অর্থ ভিন্নতা, পার্থক্য, অসঙ্গতি বৈপরীত্য প্রভৃতি। শব্দটি সাধারণত ভাষা, বর্ণ, অবস্থা, আকৃতি, মত পথ তথা যে কোনো ধরনের পার্থক্য অসঙ্গতি ও ভিন্নতা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হলেও মত ও চিন্তা-দর্শনের ক্ষেত্রে পরস্পর ভিন্ন অবস্থা গ্রহণ করার অর্থে বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, ‘ইখতিলাফ’ শব্দটি সর্বার্থে আরবী ‘দ্বিদ্দুন’ (বিপরীত) শব্দের সমার্থক নয়। কেননা, পরস্পর বিপরীত প্রত্যেক বিষয়ই ভিন্ন হয়ে থাকে; কিন্তু প্রত্যেক ভিন্ন বিষয় পরস্পর বিপরীত নাও হতে পারে। তাছাড়া ‘ইখতিলাফ’ (পরস্পর মতভিন্নতা) যেহেতু অনেক সময় বাদানুবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাই শব্দটি রূপকার্থে ‘আত্মনাযুয়ু’ তর্কবিবাদ অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ অর্থে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর এভাবে তারা হামেশাই নিজেদের মধ্যে তর্কবিবাদ করতে থাকবে।” আল-কুরআন, ১১; ১১৮
ফিকহ শাস্ত্রে ‘ইখতিলাফ’ বলতে দীনের যে কোনো ব্যবহারিক বিষয়ে শরয়ী দলীলের ভিত্তিকে মুজতাহিদ ইমামগণের পরস্পর ভিন্ন মত পোষণ করাকে বোঝানো হয়। সেই ভিন্ন মত তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে হতে পারে, কিংবা দলীলের দ্ব্যর্থকতা বা প্রচ্ছন্নতার কারণে হতে পারে অথবা দলীল সংক্রান্ত তাঁদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে হতে পারে। উল্লেখ্য যে, ইমামগণের এ মতভিন্নমতা কখনো বাহ্যিক ‘চোরি’ ও শাব্দিক ‘লাফজী/তা’বেরী’ হয়ে থাকে। “যে মন ‘আমাল ঈমানে অংশ কী না? এতদসংক্রান্ত ইমামগণের মধ্যে যে মতভেদ রয়েছে তা নিছক শাব্দিক ও অভিব্যক্তিগত। (‘আইনী, উমদাতুল কারী, খ. ১, পৃ. ২৭৬) এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ.)-এর মত হলো ‘আমাল ঈমানের অংশ নয়। কাজেই জানা যায় যে, তাঁর এ মত সত্ত্বেও কখনোই ঈমানের জন্য ‘আমাল ঈমানের মৌলিক অংশ নয়; বরং পরিপূরক শর্ত। পক্ষান্তরে অন্যান্য ইমামের মতে, ‘আমালও ঈমানের একটি অংশ। তবে তাঁদের কেউ এরূপ কথা বলেননি যে, কেউ যদি ‘আমালের ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি করে তা হলে সে বে-ঈমান হয়ে যাবে। এ থেকে বুঝা গেল, তাঁদের কথার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, ‘আমাল ঈমানের মৌলিক অংশ। বরং তাঁদের কথার উদ্দেশ্য হলোÑ‘আমাল ঈমানের একটি পরিপূরক অংশ। এতএব, এ বিষয়ে ইমামগণের মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা নিছক শাদ্বিক ও অভিব্যক্তি গত পার্থক্য; পরস্পর বিরোধী মত নয়।” কখনো তা ‘আমালের স্বরূপ নির্ণয়গত ‘একতেলাফুত্ততানায়ূ’ হয়ে থাকে, “যেমন কোনো ইমাম একটা ‘আমালকে ওয়াজিব বলেছেন, আবার অন্য ইমাম একই ‘আমালকে ফরয বলেছে। অনুরূপভাবে কোনো ইমাম কোনো একটা ‘আমালকে সুন্নাত বলেছেন, অপর কোনো ইমাম একই ‘আমালকে মুস্তাহাব্ব বলেছেন। বস্তুত প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এ মতপার্থক্যের বিশেষ কোনো প্রভাব নেই।
আবার এমনও অনেক ‘আমাল রয়েছে, যা মৌলিকত্বের বিচারে সর্বসম্মতভাবে প্রমাণসিদ্ধ; তবে এ ‘আমালসমূহ আদায়ের বিভিন্ন পদ্ধতিও সমাজে প্রচলিত রয়েছে এবং এ সব পদ্ধতি সকলের মতে মেনে চলাও জায়িয। (যেমন- দু’আ কুনূত রুকু‘র আগে বা পরে পড়া) তবে এ ‘আমালসমূহের প্রচলিত পদ্ধতিসমূহের মধ্যে কোন পদ্ধতিটি অধিকতর বিশুদ্ধ ও উত্তম? তা নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ফিকহশাস্ত্রে এরূপ মতপার্থক্যের সংখ্যাই বেশি। উল্লেখ্য যে, ইমামগণের মধ্যে জাতীয় যে মতপার্থক্য দেখা যায়, তা প্রকৃত অর্থে পরস্পর বিরোধী মত নয়। অর্থাৎ এমন নয় যে, এক ইমামের দৃষ্টিতে যেটা সাহীহ, অপর ইমামের দৃষ্টিতে সেটা বাতিল।” কখনো তা পরস্পর বিরোধী ও হয়ে থাকে, “যেমন-নাক থেকে রক্তক্ষরণ হলে অযু নষ্ট হবে কি-না? কারো মতে, এরূপ অবস্থায় অযু ভঙ্গ হবে, অপর কারো মতে, অযু ভঙ্গ হবে না। এ জাতীয় মতপার্থক্য খুব অল্প সংখ্যক মাস’আলার ক্ষেত্রে দেখা যায়।
আবার কখনো এ ভিন্নতা কেবল ‘আমালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে; হুকুম সাব্যস্ত করে না। “যেসব ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ‘আমাল করার অবকাশ রয়েছে। যথা-কুরআনের বিভিন্ন বিধিবদ্ধ কিরা’আত। হয়তো কোনো কারী কুরআনের এক ধরনের কিরা’আত অনুসরণ করেন; কিন্তু অন্য কিরা’আতগুলোকে অস্বীকার করেন না। এটা প্রকৃতপক্ষে কোনো ইখতিলাফ নয়। কেননা এ কিরা’আত গুলো প্রত্যেকটি বিশুদ্ধ বার ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য নেই। এর প্রত্যেকটিই মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত।”
উল্লেখ্য যে, আরবীতে ‘খিলাফ’ শব্দটি সাধারণত ‘ইখতিলাফ’ শব্দের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে কেউ কেউ এ দুটি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্যও করেছেন। যেমন- ‘ইখতিলাফ’ শব্দটি বিশুদ্ধ দলীলনির্ভর মতানৈক্যের ক্ষেত্রে এবং ‘খিলাফ’ শব্দটি দলীলবিহীন কিংবা দুর্বল দলীলনির্ভর মতানৈক্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। মুহাম্মাদ ইবনু আলী থানবী (রহ.) বলেন, অগ্রগণ ‘রাজিহ্’ মতের বিপরীতে দুর্বল অভিমত ‘মারযুহ্’ কে ‘খিলাফ’ বলা হয়; ইখতেলাফ বলা হয়না। ক্ষেত্রে মতভেদকারীর কথা দুর্বল হয়ে থাকে। যেমন-বলা হয় যে, সে ইজমার‘র খিলাফ করেছে। পক্ষন্তরে ‘ইখতিলাফ’Ñ এর ক্ষেত্রে মতভেদকারীর কথা দুর্বল হয় না।
আবার কারো কারো মতে, ‘খিলাফ’ ‘ইখতিলাফ’-এর চেয়ে ব্যাপকতাজ্ঞাপক। এটি ইজমা‘র বিরোধিতা ক্ষেত্রে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যক্তিবিশেষের মতের বিরোধিতার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। “আঅ-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ (কুয়েত: ওয়াযারাতুল আওকাফ…১৪০৪ হি.), খ. ২, পৃ. ২৯১-১”
আল-কুরআনের বহু আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস সকল মু’মিনকে একত্রিত থাকতে এবং পরস্পর মতপার্থক্য না করতে দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো আয়াত ও হাদীসে মতপার্থক্যে লিপ্ত হবার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে ও লোকদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এবং কখনোই মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ো না, (তাদের মধ্যে এমনও আছে যে,) যারা তাদের দীনকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে এবং তারা নানা ফেরকায় পরিণতি হয়ে গেছে। প্রত্যেক দলই নিজেদের কাছে যা কিছু রয়েছে, তা নিয়ে উৎফুল্ল।” “আল-কুরাআন, ৩০:৩১-৩২”
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, “আর তোমরা তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যাদের কাছে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং (নিজেদেরন মধ্যে নানা ধরনের মাতনৈক্য সৃষ্টি করেছে। এরাই হচ্ছে সে সব লোক, যাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে।” “আল-কুরআন, ৩: ১০৫” তিনি আরো বলেন, “ যারা এ কিতাব নিয়ে মতানৈক্যে লিপ্ত হয়েছে, তারা সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বহু দূরে নিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।” “ আল-কুরআন, ২: ১৭৬” রাসূলুল্লাহ স. বলেন, “তোমরা মতবিরোধ করো না। কেননা এতে তোমাদের অন্তরগুলোর মধ্যেও দূরত্ব তৈরি হবে।” “মুসলিম, আস-সাহীহ, অধ্যায়: সালাত, পরিচ্ছেদ: তাসবিয়াতুস সুফূফ, হা. নং: ১০০০” অন্য একটি হাদীস তিনি বলেন, “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো কেবল এ জন্যই ধ্বংস হয়ে গেলে যে, তারা (আল্লাহর) কিতাব নিয়ে মতবিরোধী করতো।” “মুসলিম, আস-সাহীহ, অধ্যায়: ‘ইলম, পরিচ্ছেদ: আন-নাহয়ু ‘আন মুতাশাবিহিল কুরআন, তাসবিয়াতুল সুফূয়, হা. নং: ৬৯৪৭”।
উপযুক্ত আয়ত ও হাদীসসমূহ থেকে জানা যায় যে, ইসলামে যে কোনো বিষয়েÑ চাই তা‘আকীদা সংক্রান্ত ব্যাপার হোক কিংবা ‘আমাল সংক্রান্ত হোক-মতবিরোধ করার কোনো নীতিগত ভিত্তি নেই। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা এবং স্বার্থপ্রণোদিত কিংবা প্রবৃত্তি তাড়িয়ে যে কোনো ইসলামের দৃষ্টিতে চরম নিন্দনীয়।
তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। মূল্যায়ন, পর্যবেক্ষণ, বিচার বিশ্লেষণ একেক জনের একেক রকম। ক্ষেত্রবিশেষ তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিতেই পারে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তোমার রাব্ব চাইলে দুনিয়ার সব মানুষকে একই উম্মাত বানিয়ে দিতে পারতেন। (কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কারো ওপর তাঁর ইচ্ছা চাপিয়ে দেন না।) আর এভাবে তারা সর্বদাই নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ করতে থাকবে। তবে তোমার রাব্ব যার প্রতি দয়া করেন তার কথা আলাদা।” “আল-কুরআন, ১১:১১৮-৯”
উক্ত আয়াত থেকে জানা যায় যে, দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ও বুদ্ধি-বিবেকগত তারতম্যের কারণে বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে যে মতভিন্নতা দেখা দেয়, তা ঘটে থাকে। এরূপ মতভিন্নতা দূষণীয় নয়, যদি তা বিশুদ্ধ দলীল ও যুক্তিনির্ভর হয় এবং শিষ্টাচার ও নীতিবিবর্জিত না হয়। ক্ষেত্র বিশেষ তা উপকারীও বটে। আমাদের সালাফে সালিহীন (পূর্বসূরী) দীনের ইজতিহাদী বিষয়ে মতপার্থক্য করেছেন। তবে তাঁদের সে মতপার্থক্যে কোনো প্রকারের জিদ, হঠকারিতা ও গোঁড়ামির স্থান ছিল না। তাঁরা মতবিরোধ করেছেন তাঁদের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনার স্বাভাবিক পার্থক্যের কারণে এবং তা ছিল অতি ক্ষণস্থায়ী। ইচ্ছাকৃত কিংবা জিদের বশবর্তী হয়ে তাঁরা কখনো মতবিরোধ করেননি। যতটুকু করেছেন তা প্রয়োজনের তাগিদে একান্ত বাধ্য হয়ে। তাঁরা যথাসাধ্য মতবিরোধ থেকে বাঁচার চেষ্টা করতেন এবং যখনই তাঁরা কোনো সঠিক দলীল পেতেন, সাথে সাথে তাঁরা সকলেই প্রসন্নচিত্তে তা গ্রহণ করে নিতেন। তাঁদের মতবিরোধের পেছনে একান্ত উদ্দেশ্য ছিল, নিজ নিজ ইজতিহাদের মাধ্যমে কুর’আন ও হাদীসের ওপর নিজেদের ও উম্মাতের ‘আমাল প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাঁদের মতবিরোধ তাঁদের মদ্যে অন্তরের সামান্যতম দূরত্বও তৈরি করেনি, তাঁদেরকে নানা দলে-উদলে বিভক্ত ও করেনি। বরং এ মত পার্থক্য সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নজীরবিহীন। পরমত সহিষ্ণুতা ছিল তাঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁদের এরূপ ইজতিহাদভিত্তিক উদারনৈতিক মতপার্থক্য বহু ক্ষেত্রে উম্মাতকে প্রশস্ততা ও দান করেছে। এ কারণে অনেকেই তাঁদের এ মতপার্থক্যকে উম্মতের জন্য রাহমাতরূপেও বিবেচনা করেছেন। “ইব্রাহীম শাতিবী, আল-মুওয়াফাকাত (দারুল ইবনি‘ আফফান, ১৯৯৭ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ৭৫”। ইসলামের পঞ্চম খলীফা সাইয়িদুনা ‘উমার ইবনু ‘আবদিল ‘আযীয় রা. সাহাবা কিরাম (রা.) এর মতবিরোধ সম্পর্কে বলেন: “রাসূলুল্লাহ (স.) এর সাহাবীগণের মধ্যে মতভিন্নতা না থাকাটা আমার কাছে আনন্দের বিষয় নয়। কেননা, যদি তাঁরা কোনো বিষয়ে মতানৈক্য না করতেন, তা হলে (পরবর্তীদের জন্য) কোনো ছাড়ই থাকতো না। “ অল-খাতীব আল-বাগদাদী, আল-ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ,   (http://www.alsunnah.com),   খ. ১, পৃ. ৪০৪; ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ২০০৫ খ্রি.) খ. ৩০, পৃ. ৮০।”।
অর্থাৎ এরূপ অবস্থায় উত্তরসূরীরা অনেক ক্ষেত্রে সংকীর্ণ অবস্থায় পড়ে যেতো। কেননা, যদি তাঁরা সব বিষয়ে ঐকমত্য পোষন করতেন, তা হলে যে কেউ কোনো বিষয়ে তাঁদের বিরোধিতা করলে সে পথভ্রষ্টরূপে পরিগণিত হতো। এখন যেসব বিষয়ে তাঁরা মতানৈক্য করেছেন, সেসব ক্ষেত্রে- যেহেতু তাঁরা প্রত্যেকেই অনুসরণীয় ইমাম, তাই-প্রত্যেকের জন্য এ অবকাশ রয়েছে যে, তিনি যে কারো অনুসরণ করতে পারেন। এ জন্য অন্ততপক্ষে কাউকে পথভ্রষ্ট বলা যাবে না। বিশিষ্ট ফাকীহ তাবি’ঈ আল-কাসিম ইবনু মুহাম্মদ [৩৭-১০৭.] (রহ.) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (স.) এর সহাবীগণের আল্লাহ তা‘আলার কল্যাণকর বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম। তুমি (তাঁদের মধ্যে) যার মাতনুযায়ী যে ‘আমালই করো না কেন, এতে তোমার মনের মধ্যে কোনো অপ্রসন্ন ভাবসঞ্চার হবে না। “আল-খাতীব আল-বাগদাদী, আল-ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, খ. ১ পৃ. ৪০৪”
উল্লেখ্য যে, সাহাবা কিরামের ইজতিহাদভিত্তিক মতপার্থক্যের মধ্যে উম্মাতের জন্য প্রশস্ততা রয়েছে এবং তা উম্মাতের জন্য রাহমাতস্বরূপ, যদিও ক্ষেত্রবিশেষে কথাটি সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়; কিন্তু এরূপ সাধারণ সমীকরণ সকলেই মেনে নিতে চান না। যেমন-ইমাম মালিক [৯৩-১৭৯ হি.] (রহ.) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (স.) এ সাহাবীগণের মতভিন্নতার মধ্যে কোনোরূপ প্রশস্ততা নেই। হক কেবল যে কোনো একজনের পক্ষেই থাকবে। পরস্পর ভিন্ন দুটি মত সঠিক হতে পারে না। “শাতিবী, আল-মুওয়াফাকাত. খ. ৫, পৃ. ৭৫” (অসমাপ্ত)