নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠতে পারে চাল আটা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডাল ও চিনির মতো ভোগ্যপণ্যের বাজার। বিশেষ করে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে চুরি ঠেকাতে ভোজ্যতেল ও ডালের দাম বাড়িয়ে বুধবার থেকে বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবি। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কিনছেন ভোক্তারা। চাহিদা বেশি থাকার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগে পণ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। এতে করে অনেকেই দীর্ঘ অপেক্ষার পরও খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।
শুক্রবার সারাদেশে বাস ও ট্রাক ধর্মঘটের কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। এর ফলে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও দু’একটি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। আটা, আলু ও সবজির দাম বাড়লেও কমেছে ডিম, পেঁয়াজ ও মসুর ডালের দাম। জরুরী ভিত্তিতে পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, পণ্য সরবরাহকারী ট্রাক, লরি ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল স্বাভাবিক না হলে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। এমনিতে গত কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এ অবস্থায় চলমান সঙ্কটের খেসারত দিতে হবে দেশের সাধারণ মানুষ বা ভোক্তাকেই। তাদের আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি ঘটাবে।
ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রভাব কাঁচাপণ্যের বাজারে পড়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন ক্রেতারাও। ৬৫ টাকা লিটারের ডিজেল এখন কিনতে হচ্ছে ৮০ টাকায়। এর ফলে কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার বাজারে তাৎক্ষণিক জিনিসপত্রের দাম না বাড়লেও শীঘ্রই নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাল, পেঁয়াজ, চিনি, মাছ-মাংস ও ব্রয়লার মুরগি আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী মোঃ হালিম শিকদার বলেন, ধর্মঘটের কারণে শুক্রবার ঢাকার বাইরে থেকে কোন পণ্যবাহী ট্রাক ও লরি আসেনি। এমনকি কাওরান বাজার থেকে পণ্য কিনে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে নিতেও সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চলমান ধর্মঘটের দ্রুত অবসান হওয়া উচিত। মুদি পণ্যের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দাম এখনও তেমন বাড়েনি। দুই-একটা সবজির দাম বাড়ছে। এটা প্রতিদিনের মতোই বাড়ছে। তবে পরিবহনের খরচ বাড়লে সবজির দাম বাড়বে।
চুরি ঠেকাতে ভোজ্যতেল ও ডালের দাম বাড়িয়েছে টিসিবি : চুরি ঠেকাতে টিসিবির ভোজ্যতেল ও ডালের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত বুধবার থেকে নতুন দাম কার্যকর করেছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খুচরা বাজারের তুলনায় টিসিবির পণ্য তুলনামূলক বেশি কমদামে বিক্রি হচ্ছে ট্রাকসেল কার্যক্রমে। এতে করে টিসিবির পণ্য নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন কারসাজি। টিসিবির গুদাম থেকে পণ্য নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ট্রাক থেকে পণ্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষ ট্রাকসেল কার্যক্রম থেকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় পণ্য পাচ্ছে না। আবার দাম কম হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে সাধারণ ভোক্তারাও। একই মানুষ প্রতিদিন লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনছেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্পট থেকে পণ্য সংগ্রহ করে সেই পণ্য বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এতে করেও বঞ্চিত হচ্ছে কিছু সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আগের দামে টিসিবির সরবরাহকারীরা পণ্য দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, খুচরা বাজারের তুলনায় টিসিবির পণ্যের দাম কম হওয়ার কারণে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ট্রাক থেকে পণ্য চুরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া একই ক্রেতা বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য কিনে তা আবার বাজারে বিক্রি করছেন। এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেশি। সবকিছুর সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়াতে হচ্ছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল ও মসুরের ডাল বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, অন্যদুটি আইটেম আগের দামে বিক্রি হবে। মঙ্গলবার পণ্যের দাম বাড়িয়ে প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে টিসিবি।
এতে প্রতিলিটার ভোজ্যতেলে ১০ টাকা বাড়িয়ে ১১০ টাকা করে হয়েছে। খুচরা বাজারে প্রতিলিটার সয়াবিন তেল বর্তমান ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি মসুর ডালে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬০ টাকা নতুন দাম ঘোষণা করেছে টিসিবি। এছাড়া আগের দামে প্রতিকেজি চিনি ৫৫ এবং প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে। আজ বুধবার থেকে ফের বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়ে আগামী ২৮ নবেম্বর পর্যন্ত শুক্রবার ব্যতীত বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। একজন ভোক্তা প্রতিটি আইটেমে সর্বোচ্চ ২ কেজি কিনতে পারবেন। তবে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সেই পরিমাণ কিছুটা বাড়াতে পারে।
খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে টিসিবির চারপণ্য প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিকেজি মসুর ডাল খুচরা বাজারে ৯০-১২০ টাকা, প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৫০-৬০ টাকা এবং প্রতিকেজি চিনি ৭৮-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে আগামী দিনে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, পণ্যের দাম বাড়ানো হলেও সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে ট্রাকসেলে বিক্রি কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে। সারা বছর টিসিবির কার্যক্রম চালু রাখা হতে পারে। টিসিবি কার্যক্রমে গত অর্থবছরে ৭০০ কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল। এবার সেই ভর্তুকির পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কম হওয়ার কারণে ভর্তুকির পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে টিসিবির ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য নিয়ে বিক্রির জন্য নির্ধারিত পয়েন্টে ট্রাক পৌঁছানোর আগেই লোকজন অপেক্ষায় থাকেন। আর বিক্রি শুরুর দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে পণ্য শেষ হয়ে যায়।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরাও পাল্লা দিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছেন। এতে করে বাজারে পণ্যের দামে অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন মার্কেট থেকে বাজার করছিলেন শাজাহানপুরের বাসিন্দা আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। এছাড়া চাল, চিনি, আটা, মুরগি ও সবজিসহ প্রতিটি পণ্যের দাম চড়া। ৮০ টাকার নিচে বাজারে কোন সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। এর পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে। দ্রুত পণ্যের দাম কমিয়ে আনা উচিত।
চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এর সঙ্গে জিনিসপত্রের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। গত কয়েক মাস ধরেই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ৮৫ থেকে ১০৫ টাকার সয়াবিন তেলের দাম কয়েক দফায় বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১৬০ টাকায় নেয়া হয়। ৪০-৪৫ টাকার পেঁয়াজ ঠেকেছে ৮০ টাকায়। এখন যদিও কিছুটা কমে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এই সময়ে থেমে ছিল না জীবনধারণে অন্যান্য পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধিও। এমন পরিস্থিতিতে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনে দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। অর্থাৎ তেলের দাম প্রতি লিটারে ২৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ১২ কেজির সিলিন্ডারের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম দুই দফায় ২৮০ টাকা বাড়ানো হয়।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণকারী সংগঠনগুলোর দাবি, জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বাড়বে পরিবহন ব্যয় ও পণ্যের উৎপাদন খরচ। তবে এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহন মালিকদের কোন ক্ষতি হবে না। তারা দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ ঠিকই সমন্বয় করে নেবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রেতা-ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদের আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি ঘটাবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে। বাংলাদেশও দাম সমন্বয় করছে। এই দাম সমন্বয়ের প্রভাব শুধু পণ্যমূল্যে নয়, আরও যেখানে যেখানে পড়ার কথা, পড়বে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দেশে বেসরকারী সংগঠন কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন ছড়াবে বলে আশঙ্কা করছে ক্যাব। অন্যদিকে, শুক্রবার দাম বেড়ে প্রতিকেজি আটা ৩৮-৪০, আলু ২২-২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া দাম কমে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৪০-৬০ টাকায়, মসুর ডাল ৮৫-১১০ ও ডিম ৩৭-৩৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে খুচরা বাজারে। এছাড়া চাল, ভোজ্যতেল ও চিনির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।