প্রশাসনে পদোন্নতি পেতে তদবিরের ছড়াছড়ি ॥ কখনও ডিও লেটার, কখনও ফোন, কখনও সরাসরি কথা

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরকারী চাকরিতে পদোন্নতি পেতে তদবিরের ছড়াছড়ি শুরু হয়েছে। এ তদবির হয় কখনও ডিও লেটারের (ডেমি অফিসিয়াল লেটার বা সরকারী বিষয়ে বেসরকারীভাবে লেখা পত্র) মাধ্যমে, কখনও টেলিফোনে, আবার কখনও সরাসরি কথা বলে। সীমাহীন তদবিরে প্রশাসনের পক্ষে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও হতবাক।
নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি প্রশাসনে রুটিন ঘটনা। কিন্তু ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রে এখন তদবিরের ওপর নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। মেধা বিকাশের পরিবর্তে পদোন্নতির জন্য কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ এখন ডিও লেটারের পেছনে দৌড়ঝাঁপের পথ বেছে নিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে কোন কোন কর্মকর্তা জাল ডিও লেটারও জমা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ প্রক্রিয়ায় সফলতা এলে অযোগ্যদের ভিড়ে যোগ্যরা হারিয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে এহেন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। পদোন্নতির ক্ষেত্রে তদবিকে তারা নেতিবাচক যোগ্যতা হিসেবে দেখছেন। এসএসবির এক প্রভাবশালী সদস্য বলেন, যে যেমনে পারে তদবি করছে। পদোন্নতি পেতে অনেকেই মন্ত্রী, এমপিসহ প্রভাবশালীদের ডিও লেটার জমা দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলেন, আমরা ডিও লেটারকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। বরং যারা ডিও লেটার নিয়ে জমা দিচ্ছেন তাদের যোগ্যতাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শাস্তিমূলক অপরাধ জানার পরও তদবিরেই ভরসা হিসেবে মনে করছেন প্রশাসনের বহু কর্মকর্তা। পদোন্নতিতে পদায়ন পেতে, বদলির জন্যÑ সব কিছুতেই তদবিরের যেন ছড়াছড়ি। ইদানীং সচিব হওয়ার জন্যও তদবি করাচ্ছেন অনেকে। সচিব হয়েছেন, কিন্তু সিনিয়র সচিব হতে পারলেন না- তার জন্যও তদবির। মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতি বা সদস্য, সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অর্থাৎ রাজনীতিবিদরা পছন্দের আমলাদের জন্য তদবির করছেন। রাজনীতিবিদদের মতো আমলারাও জুনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য তদবির শুরু করেছেন। এসব আনুষ্ঠানিক তদবিরের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক তদবির তো রয়েছেই। ডিও লেটার প্রদান বা বিভিন্নভাবে তদবিরের বিষয়টি নতুন নয়। অতীতেও কম-বেশি এ প্রক্রিয়ায় কাজ হয়েছে। এতে কেউ সফলতা লাভ করেছেন, আবার কেউ ব্যর্থও হয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে প্রশাসন উর্ধতন কর্তা-ব্যক্তিরা সকলেই যেন ডিও লেটার বা তদবিরের বহুমুখী তৎপরতাকে বেছে নিতে শুরু করেছেন, যা মেধাবি কর্মকর্তাদের জন্য কখনও সুখকর নয়।
ডিও লেটার নিয়ে জমা দেয়া এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন উপায়ে তদবির করানো যেন মহামারীতে রূপ নিচ্ছে। দিন দিন এ প্রক্রিয়াটি বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ডিও লেটার বা আধাসরকারী পত্রের মাধ্যমে তদবিরের হার বেড়েছে। ডিও লেটারকে উপানুষ্ঠানিক পত্রও বলা হয়। স্বাভাবিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সহজেই অফিসে পাওয়া যেত। কিন্তু করোনা মহামারীতে তারা ৯টা ৫টা অফিস করেন না। আর অফিস করলেও তাদের রুমে প্রবেশের ওপর রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। এ কারণে ডিও লেটার লিখে তা সংশ্লিষ্ট দফতরে পৌঁছানো হচ্ছে। তারপর ডিও লেটারের সূত্র ধরে তদবিরের পরবর্তী ধাপ শুরু হয়। অথচ পদোন্নতি, পদায়ন, বদলি সব কিছুর জন্য নিয়ম রয়েছে। কর্মকর্তারা সেই নিয়মে আস্থা রাখতে পারছেন না বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার জানান, তদবির সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কারো পদোন্নতি পোস্টিংয়ের জন্য বা অন্য কোন কারণে তদবির করা যাবে না। মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা বা অন্য যে কেউÑ কোন কর্মকর্তার জন্য তদবির করতে পারেন না। সরকারী কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী রাজনৈতিক নেতারা তদবির করতে পারেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র মন্ত্রী জানান, তদবিরের চিঠিতে বা ডিও লেটারে কী লেখা হবে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজেই নির্ধারণ করেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সম্পর্কে কিছু প্রশংসাসূচক বাক্য থাকে- যা ওই কর্মকর্তাই লিখে আনেন। কর্মকর্তারা কম্পিউটারে লিখে সেটা পেন ড্রাইভে করে বা মেইলে মন্ত্রীর দফতরে পাঠান। তারপর মন্ত্রীর নির্ধারিত প্যাডে তা প্রিন্ট দিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে তা পাঠানো হয়।
অপর একজন সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী জানান, তিনি কারো জন্য ডিও দিতেন না। তার মতে সুবিধাভোগী লোকজন ডিও লিখিয়ে নিয়ে যায়। যা নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা হয়। খুব কম লোকই মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। সাধারণ মানুষের পক্ষে ডিও নেয়া সম্ভব হয় না। তাই তিনি ডিও দিতেন না। ডিও না দেয়ার কারণে তার এলাকার এক ভোটার এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে তিনি ব্যালট পেপারে লিখেদিয়েছেন ‘ডিও নাই তো ভোটও নাই। আপনি ডিও দেননি তাই আমি ভোট দেইনি।’
একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করেন তদবিরের জন্য। মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতর অধিদফতরে মালামাল সরবরাহ করবে তার জন্য সরবরাহকারীরা তদবির করাতে মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে যায়। আর বড় কাজ হলে তো কথাই নেই। কত কিসিমের যে তদবির তা সচিব না হলে বুঝা যায় না বলে জানিয়েছেন তিনি।
সবচেয়ে বেশি তদবির কোন বিষয়ে? প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বদলির জন্য সবচেয়ে বেশি তদবির করতে হয়। বেশিরভাগ লোকই বর্তমান অবস্থানে খুশি নন। তারা তদবির করে ভাল জায়গায় পোস্টিং নিতে চান। এই ভাল জায়গা বলতে বোঝায় উৎকোচের জায়গা। বর্তমানে যেখানে আছেন সেখানে উৎকোচ কম। তাই উৎকোচ যেখানে বেশি সেটা তাদের কাক্সিক্ষত জায়গা। সরকারী একটা বাসার জন্য যে পরিমাণ তদবির করতে হয়- সেটা বলার বাইরে। গ্রামের লোকজনও তদবির করাতে আসে। সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাকরির জন। তারা মনে করে একজন সচিব বলে দিলেই সব হয়ে যায়। আসলে সচিব কেন মন্ত্রীদের তদবিরেও অনেক সময় কাজ হয় না।
একজন সিনিয়র মন্ত্রী জানিয়েছেন, তদবির তো করতেই হবে। এলাকার মানুষের জন্য কাজ করব সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েই এমপি হয়েছি। কিন্তু তদবির যে বেআইনী। তদবিরকে সরকারী কর্মচারীদের অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারী কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালায় এ বিষয়ে স্পষ্ট বলা আছে। তারপরও সরকারের মন্ত্রী বা সচিবরা তদবির করেন।
সরকারী কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মচারী তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোন অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন সংসদ সদস্য বা অন্য কোন বেসরকারী ব্যক্তির দারস্থ হতে পারবেন না।
তদবির যে নিষিদ্ধ তা মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি জানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। কাজেই ওরা যদি জেনে আসতে পারে তাহলে আমার দিতে আপত্তি কোথায়। মন্ত্রীরা তো কর্মকর্তাদের তদবির করতে বসে থাকেন না। কর্মকর্তারা অনুরোধ করে মন্ত্রীকে দিয়ে ডিও লেটার লেখান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, স্বল্প বাজেটের এক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।