মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক :
মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল (সাঃ)-এর আগমন উপলক্ষে আল্লাহর শুকরিয়ার্থে শরীয়ত সম্মতভাবে খুশি উদযাপন করাই হলো সুন্নি আক্বিদা। মিলাদুন্নবী মুসলমানদের জন্য এমন একটি আনন্দোৎসব, যার কোনো তুলনা হয় না। ‘ঈদ’ সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত আরবি অভিধান আল-মুনজিদের ৫৩৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, কোন কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়ার দিন বা স্মৃতিচারণের দিবসই ঈদ। কাওয়াইদুল ফিকহ্-এর ৩৯৬ পৃষ্ঠায় ঈদকে ‘ঈদ’ বলার কারণ হচ্ছে- প্রতিবছর আনন্দ নিয়ে তা ফিরে আসে। ‘মিলাদ’ সম্পর্কে আল-মুনজিদের ৯১৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘মিলাদ’ অর্থ জন্ম সময়, যা কারো ঐ দিবসে পরবর্তীকালে শুকরিয়া হিসাবে পালন করা হয়। আল্লামা ইবনে মানযুর (রহঃ) তাঁর প্রসিদ্ধ অভিধান ‘লিসানুল আরব’ লিখেছেন, ‘মিলাদ’ মানে যে সময়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে সে সময়ের নাম। স্বভাবতই ‘মিলাদ’ বা ‘মিলাদুন্নবী’ বলতে শুধুমাত্র রাসূল (সাঃ)-এর জন্মের সময়ের আলোচনা, জীবনী পাঠ, তাঁর বাণী, তাঁর শরিয়ত বা তাঁর হাদিস আলোচনা, তাঁর আকৃতি-প্রকৃতি আলোচনা, তাঁর উপর একাকী বা সম্মিলিতভাবে দরুদ শরীফ পাঠ, সালাম পাঠ, কিয়াম ইত্যাদি বুঝায়। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের পরওয়ার দিগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময় হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য। (হে রাসূল (সাঃ)) বলুন-আল্লাহর অনুগ্রহে এবং তাঁর দয়া, সুতরাং তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। (সূরা ইউনুছ-৫৭)। তাই গ্রষ্টার সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব রাসূল (সাঃ)-এর শুভাগমন। অন্যত্রে ইরশাদ হচ্ছে-“হে রাসূল (সাঃ) আপনি বলুন, আল্লাহ পাকের ফজল ও রহমত প্রাপ্তিতে তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে; তোমাদের পুঞ্জিভূত সম্পদ অপেক্ষা এটি কত উত্তম!” (সূরা ইউনুছ-৫৮)। “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে এক উজ্জ্বল জ্যোতি (নূর) ও সুস্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে। (সূরা মায়েদা-১৫)। কোরআনের অমিয় বাণী নিয়ে যিনি এ ধরায় আগমনে আমাদের ধন্য করেছেন, তাঁর আগমনে আনন্দোৎসব করা উম্মতে মোহাম্মদীসহ সকল ধর্ম-বর্ণের, জাতির জন্য অবশ্য কর্তব্য।
ঈসা (আঃ)-এর পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ ধরায় নবি রাসুলের আগমন ঘটেনি। এমতাবস্থায় বিশ্বের সর্বত্রই অত্যাচার-অনাচার, কুসংস্কার, নিষ্ঠুরতা ও সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এহেন চরমতম মানবিক অসাম্য ও মানবাধিকার বৈষম্যের ঘোর অন্ধকার যুগে আবির্ভূত হলেন মানবতার মুক্তির দিশারী রাসূল (সাঃ)। তারপর থেকে পৃথিবীর সমস্ত জমিনই মসজিদে পরিণত হল। যার ফলে আমরা মসজিদে ঘরে যানবাহনে পথে-ঘাটে সবখানেই নামাজ পড়তে পারছি। রাসূল (সাঃ)-এর আগমনে আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হল আহলান ছাহলান, মারহাবান-মারহাবান! মা আমেনা বলেন তাঁর জন্মলগ্নের পর মুহুর্তেই একটা নূর প্রকাশিত হল যার আলোতে পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের সবকিছু আলোকিত হয় এবং যার আলোতে সিরিয়ার শাহী মহল মা আমেনা দেখতে পান। (বায়হাকী দালায়েলুন নবুওত মুসনাদে আহমদ)। রাসূল (সাঃ) দুনিয়াতে তশরিফ আনার সাথে সাথে ক্বাবা শরীফ মাকামে ইব্রাহীমের দিকে ঝুঁকে পড়ে রাসূল (সাঃ)-এর বেলাদাতের তাজিম করেছিল। (মাদারেজুন্নবুয়ত)।
সৈয়দ মুফতী আমীমুল এহসান (রহঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, বৃদ্ধ সর্দার আবদুল মোত্তালেব পৌত্রের জন্মের সুসংবাদ শ্রবণ করে গৃহে আগমন করেন এবং নবজাতক শিশুকে খানা-ই-কাবায় নিয়ে যান এবং দোয়া করেন। সপ্তম দিবসে আকীকা করে, ‘মোহাম্মদ’ (সাঃ) নাম রাখেন এবং সমগ্র কোরেশকে দাওয়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার এই সন্তান সমগ্র বিশ্বে প্রশংসার অধিকারী হবে’। আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রহঃ)-এ সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত পুস্তক ‘মা সাবাতা বিসসুন্নাহ’তে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। ১২ রবিউল আউয়াল (সোমবার) রাসূল (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন বলে প্রসিদ্ধ বর্ণনায় বলা হয়েছে। এ দিন মক্কাবাসীরা রাসূল (সাঃ)-এর জন্মস্থান জিয়ারত করত। জন্মরাতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রহঃ) বলেন, এই রাত শবে ক্বদর হতে উত্তম। কেননা তাঁর শবে বেলাদত হচ্ছে তাঁর জন্মরাত এবং শবে কদর তাকে প্রদান করা হয়। যে রাত্রটিকে তাঁর আবির্ভাবে সম্মানিত করা হয়েছে এটি শবে ক্বদর অপেক্ষা উত্তম, তাছাড়া শবে ক্বদরে শুধু আসমান হতে ফেরেশতারা আগমন করে থাকেন, পক্ষান্তরে জন্মদিবসের রাতে রাসূল (সাঃ)-এর সুমহান সত্তার আবির্ভাব ঘটে। জন্মরজনীর শ্রেষ্ঠত্বের আরও একটি কারণ হচ্ছে, শবে ক্বদরের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব শুধু উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য নির্ধারিত, পক্ষান্তরে রাসূল (সাঃ)-এর মহান সত্তাকে আল্লাহ সকল জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ নির্ধারণ করেছেন এবং তাঁরই মহান জাতিসত্ত্বার গুণাবলীর কারণে আসমান, জমিন ও সকল মাখলুকাতকে আল্লাহ সাধারণ নিয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- -হে রাসূল (সাঃ) ‘আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের জন্য একমাত্র রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া-১০৭)।
কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের সাথে তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের নির্দেশ রয়েছে। তাঁর প্রতি ভালবাসা, আল্লাহর প্রতি ভালবাসা স্বরূপ। যাঁর মধ্যে উত্তম আদর্শ, কোরআন যাঁর মহান চরিত্র এবং যাঁর প্রতি খোদ আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ দরূদ পাঠ করে থাকেন, তাঁর জন্মোৎসব উদযাপন করার সৌভাগ্য আল্লাহর এক মহান অবদান। ইরশাদ হচ্ছে- ‘এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।’ (সূরা ইনশেরাহ-৪)। রাসূল (সাঃ)-এর রওজা শরীফে ৭০ হাজার ফেরেস্তা আকাশ হতে মিছিল সহকারে দৈনিক ২ বার ফজরে ও আছরে আসেন এবং সালাম পেশ করতে থাকে। কিয়ামত পর্যন্ত এ নিয়ম চলতে থাকবে। আদম (আঃ) হতে ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সকল নবি ও রাসলগণ মিলাদুন্নবী এর মজলিস পালন করতেন (মাদারেজুন্নবুয়ত)। ইরশাদ হচ্ছে-“নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফিরিস্তাগণ রাসূল (সাঃ)-এর উপর দরুদ পেশ করছেন।” “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ও তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পেশ কর আদবের সাথে। (সূরা আহযাব-৫৬)। আদম (আঃ) সৃষ্টির পরে দেখলেন আরশে আজিমে খোদিত রয়েছে- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।” তখন তিনি আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন-হে পরওয়ার দেগার! আপনার নামের পাশে ওটা কার নাম শোভা পাচ্ছে। তখন আল্লাহপাক বললেন- ইনি হলেন আখেরী জমানার নবী আমার প্রিয় হাবীব রাসূল (সাঃ)। যার উছিলায় তোমাকে ও সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছি। যার উছিলায় সমগ্র পৃথিবীর, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারা, কীট-পতঙ্গ, আসমান-জমিন, পশু-পাখি, গাছপালাসহ মানবমন্ডলী সৃষ্টি করা হয়েছে। সে জন্য আমাদের উচিত সাধারণ নেয়ামত পাওয়ার জন্য যদি ঈদ বা খুশি করতে পারি, তবে সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ যিনি, তাঁর আগমনে খুশি করা কত যে উত্তম কাজ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
হে উম্মতে মোহাম্মদীগণ! আসুন যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর ফেরেস্তাদের নিয়ে এবং নবী-রাসূল, সাহাবী, ওলী-আউলিয়া সবাই নবির প্রতি যথাযথ দরুদ ও সালাম প্রদর্শনসহ মিলাদুন্নবী পালন করে আসছেন, সেখানে উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে সমগ্র বিশ্বের রহমত, সমগ্র জাতির আদর্শ রাসূল (সাঃ)-এর মিলাদুন্নবী পালনে কৃপনতা না করে আমরা সুদৃঢ় হই। মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করি, বেশি বেশি দান-খয়রাতসহ মিলাদুন্নবীর মাসে শরীয়তসম্মত আমল করি। জন্মদিবস পর্যন্ত তাঁর স্মরণ সীমাবদ্ধ না রেখে, আল্লাহর জিকিরের ন্যায় সার্বক্ষণিকভাবে বিশ্বনবির প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করি। সমস্ত শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে, মসজিদ-মাদ্রাসায়, খানকাসহ ঘরে ঘরে নবির আগমনি দিবসকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করি।