কাজিরবাজার ডেস্ক :
উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে বেশি বেতনে চাকরির আশ্বাস। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশীদের পাচার করা হচ্ছে লিবিয়ায়। বাংলাদেশ থেকে এক বছর চার মাস আগে লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশীকে সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের মিজদায় একসঙ্গে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে লিবিয়ার মাফিয়ারা। লিবিয়ায় পাচার করার ঘটনায় দায়ের করা ২৫টি মামলার তদন্ত করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। মানব পাচারকারী ও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে দায়ের করা ২৫ মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা ২৯৯ জন। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১৭১ জন। আর তাদের মধ্যে ৪২ জন এরই মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ২৪ মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করেছে সিআইডি। একজন আসামির নাম একাধিক মামলায় থাকায় আসামির সংখ্যা ২৮০ জন হলেও প্রকৃতপক্ষে চার্জশীটভুক্ত আসামির সংখ্যা ২৫৩ জন। এর মধ্যে ১৩৫ মানব পাচারকারী এখনও পলাতক। সিআইডির অনুরোধে লিবিয়ায় মানবপাচার মামলার ৬ পলাতক আসামিকে ধরে দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ পুলিশ সংস্থার (ইন্টারপোল) রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। সারাদেশের মানব পাচারকারী চক্রের নেটওয়ার্ক ১৫ জেলায় বিস্তৃত। দেশের ভেতরে মানব পাচারের ১৪ চক্র ও লিবিয়া-ইউরোপে আরও ৪ চক্র মিলে মোট ১৮ চক্র সক্রিয় এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। র্যাব এ মামলাগুলোর আসামিদের গ্রেফতার ও ছায়া তদন্ত করেছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ভাগ্য পরিবর্তনের প্রলোভনে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশীদের ইউরোপে নিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছিল লিবিয়ায়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত বাংলাদেশীকে সংগ্রহ করে দালাল চক্রের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে লিবিয়ায় পাচার করে আসছে মানব পাচারকারী চক্র। ২০২০ সালের ২৭ মে লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশীকে সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের মিজদায় একসঙ্গে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে লিবিয়ার মাফিয়ারা। এতে আহত হন আরও ১২ বাংলাদেশী। লিবিয়ায় পাচারের শিকার ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে মামলা হয়েছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২৪টি মামলায় ২৫৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। অন্য একটি মামলাও গুছিয়ে এনেছে সংস্থাটি। অভিযোগপত্রে বলা হচ্ছে, লিবিয়ায় মানবপাচারে চারটি দেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করেছেন মানব পাচারকারী চক্র। লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচারের নেটওয়ার্ক ঢাকাসহ দেশের ১৫ জেলায় বিস্তৃত। এতে ১৪ চক্রের ৩ শতাধিক সদস্য সক্রিয় আছে। লিবিয়ায় সক্রিয় আছে বাংলাদেশী আরও চারটি চক্র। মোট ১৮টি চক্র মিলে লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচার করছে।
গ্রামের যুবকদের টার্গেট করা হয় : সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, দালাল ধরে লিবিয়ায় যাওয়া এসব ভুক্তভোগীকে খরচ করতে হয়েছিল ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। এই অর্থ খরচ হয়েছে বিভিন্ন ধাপে। তার মধ্যে গ্রামের এই যুবকদের প্রথম যে দালাল টার্গেট করে প্রলোভনে ফেলেন, তিনি (দালাল) পেয়েছেন ৫ হাজার টাকা। পরের বিভিন্ন ধাপে চক্রটি দেশেই ‘কাজে লাগান’ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। প্রথম দালাল থেকে লিবিয়া পর্যন্ত চক্রের সব সদস্যের বিষয়েই উল্লেখ আছে অভিযোগপত্রে। এসব আসামির অধিকাংশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, মাদারীপুর, কুষ্টিয়া ও নরসিংদী জেলায়।
চার দেশ পেরিয়ে লিবিয়ায় : অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করে সিআইডির সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, লিবিয়ার ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ২০০৮ সালের দিকে বাংলাদেশীরা দেশটিতে কাজের জন্য যেতে শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশীরাও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সেখানে নিয়ে যেতেন, আবার অনেকে টাকার বিনিময়েও ইউরোপে লোকজন নিতেন। এভাবেই এক পর্যায়ে লিবিয়া অভিবাসনের রুট হিসেবে পরিচিতি পায়; গড়ে ওঠে মানব পাচারকারী চক্র। দেশ থেকে লিবিয়ায় যেতে ব্যবহার করা হতো চারটি দেশ ভারত, নেপাল, দুবাই ও মিসর। ঢাকা থেকে প্রথম গন্তব্য থাকে এই দেশগুলোর বিভিন্ন শহরে। সেখান থেকে লিবিয়া। তারপর সেখান থেকে ডিঙ্গি নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ইতালি কিংবা অন্য কোন ইউরোপীয় দেশে। পাচারের পথে ধাপে ধাপে এক চক্রের হাত থেকে আরেক চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয়। দীর্ঘ সময় নিয়ে চলে এই অনিশ্চিত যাত্রা। এক মাস, দু’মাস কখনও আবার তারও বেশি।
লিবিয়ায় পাচারের রুট ও সময় : সিআইডি বলছে, অবৈধভাবে যারা ইউরোপে ঢুকতে চায়, তাদের জন্য সুবিধাজনক জায়গা হচ্ছে লিবিয়া। বাংলাদেশ থেকে অনেকে নানা উপায়ে লিবিয়া পৌঁছে। এরপর সেখান থেকে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যেতে সচেষ্ট হয় অধিকাংশই। ভাগ্য বদলাতে যারা ইতালি যাত্রায় শামিল হন, নির্মম পরিহাসে দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত সাগরে ডুবে মারা যায় এদের অনেকেই।
মিজদায় সেদিন যা ঘটেছিল : মামলার চার্জশীটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ভিকটিমরা দীর্ঘ চার মাস লিবিয়ার ওই ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করেন। এরপর উন্নত জীবনযাপনের আশ্বাসে ২০২০ সালের ১৬ মে ইতালিতে পাঠানোর জন্য তিনটি মাইক্রোবাসে করে বিজয়, সাইদুল ও তরিকুলসহ ৩০ জন বাঙালীকে ত্রিপোলির উদ্দেশ্যে রওনা করানো হয়। মাগরিবের নামাজের আগে বিস্তীর্ণ মরুভূমির ফাঁকা রাস্তায় পৌঁছালে লিবিয়ার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা ভিকটিমদের মাইক্রোবাসকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এরপর রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে তাদের পিকআপ ভ্যানে উঠিয়ে গোপন আস্তানায় নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। সেখানে তিনদিন আটকে রাখার পর ২৯ বাংলাদেশীকে মিজদার আরেক মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। মিজদার মাফিয়ারা পরের দিন মরুভূমির ভেতর একটি গোপন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ৩৮ বাংলাদেশী এবং প্রায় ১৫০ আফ্রিকান (ঘানা, নাইজিরিয়া ও সুদানের নাগরিক) আটক ছিল। মাফিয়ারা বাংলাদেশীসহ আটকদের প্লাস্টিকের পাইপ, লোহার শিকল ও ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন করতে থাকে। ভিকটিমদের নির্যাতনের চিৎকার ইমোতে ভয়েস কলের মাধ্যমে তাদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ১২ হাজার ইউএস ডলার মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণের জন্য মাফিয়াদের নির্যাতনের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। আটক আফ্রিকানদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিপণের জন্য ভীতি ও ত্রাসের সৃষ্টি করে।
এই অবস্থায় ২৭ মে সকাল ৯টায় মাফিয়ারা ক্যাম্পে ঢুকে মুক্তিপণের জন্য পুনরায় আফ্রিকানদের ওপর নির্যাতন করতে থাকে। আফ্রিকানরা মাফিয়াদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করলে মাফিয়ারা তাদের পিস্তল দিয়ে গুলি করে ২/৩ আফ্রিকান ও বাঙালীকে হত্যা করে। দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্পে আটক আফ্রিকানরা প্রতিশোধের জন্য মাফিয়াদের লিডারকে পিটিয়ে হত্যা করে। এর জেরে মাফিয়ারা তাদের লিডার হত্যার বিষয়টি তাদের সহযোগী অন্যান্য অজ্ঞাতপরিচয় মাফিয়াদের মোবাইল ফোনে জানায়। দুপুর ২টার দিকে অস্ত্রধারী মাফিয়ারা ট্যাঙ্ক ও গাড়িসহ ক্যাম্পে ঢুকে প্রতিশোধ হিসেবে একযোগে বৃষ্টির মতো আফ্রিকান ও বাঙালীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। এতে ভিকটিম বিজয়সহ ২৬ বাংলাদেশী নিহত হন এবং ভিকটিম সাইদুল ও তরিকুলসহ ১২ জন গুরুতর আহত হন। সন্ত্রাসীরা আহতদের এ্যাম্বুলেন্সে করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আহতদের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় রাতে তাদের মরুভূমির ভেতরে একটি ডাস্টবিনের কাছে ফেলে রেখে চলে যায়। সকালে মরুভূমির পথ ধরে দেড় কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার পথে দুজন লোকের সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভিকটিমরা তাদের ঘটনার বিষয়ে সব জানানোর কিছু পর লিবিয়ান সেনাবাহিনী এসে ১২ জনকে উদ্ধার করে ত্রিপোলির ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতবাসের সহায়তায় ভিকটিমদের হাসপাতালে ভর্তি করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ হলে দেশে ফেরত পাঠায়।
পল্টন থানায় মামলা দায়ের : এ ঘটনায় ২০২০ সালের ২ জুন ৩৮ জনকে আসামি করে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) এইচ এম রাশেদ ফজল। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে এবং হত্যার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর- ১(৬)২০। মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ৩০-৩৫ জনকে।
অভিযুক্ত ৪১ জন : মামলার অভিযুক্তরা হলেন- তানজিদ ওরফে তানজিমূল ওরফে তানজিরুল (৩৬), জোবর আলী (৬২), জাফর মিয়া (৩৮), স্বপন মিয়া (২৯), মিন্টু মিয়া (৪১), শাহিন বাবু (৪৫), আলী হোসেন (৩৭), আমির হোসেন (৫৫), নজরুল মোল্লা (৪৩), আ. রব মোড়ল (৪০), সজীব মিয়া (২৫), মুন্নী আক্তার রূপসী (২০), রবিউল মিয়া (৪২), রুবেল শেখ (৩৬), আসুদুল জামান (৩৪), বাহারুল আলম (৬৭), নাজমুল হাসান (২৫), হেলাল মিয়া (৪২), কামালউদ্দিন (৫২), কামাল হোসেন (৪০), রাশিদা বেগম (৪২), নুর হোসেন শেখ (৫৫), ইমাম হোসেন শেখ (৩৫), আকবর হোসেন শেখ (৩২), বুলু বেগম (৩৮), জুলহাস সরদার (৪৫), দিনা বেগম (২৫), শাহাদাত হোসাইন (৩০), জাহিদুল আলম (৪২), জাকির মাতুব্বর (৬০), লিয়াকত আলী শেখ (৫০), নাসির বয়াতী (২৫), রেজাউল বয়াতী (৩৮), হাজী শহীদ মিয়া (৬৩), খবির উদ্দিন (৪৭), পারভেজ হাসান, কামছার মুন্সি (৩৫), মাহাবুব মুন্সি (৫৩), পারভেজ আহমেদ (৩৩), নজরুল ইসলাম সুমন (৩৮) ও কাউসার (৪০)। মামলাটি এখন বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
লিবিয়ায় নিহত একজনের ভাইয়ের জবানবন্দী : সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ার মিজদাহ শহরে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কিশোরগঞ্জের যুবক মোঃ আকাশ। তাঁর ভাই নাজির হোসেন পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে বলেন, ঢাকার মানব পাচারকারী হাজি কামালের মাধ্যমে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে লিবিয়া যান। সেখানে অল্প টাকা বেতন পেতেন। লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের হোতা তানজিদুল ত্রিপোলিতে বেশি বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা নিলেও সেখানে পাঠাননি। নাজির হোসেন জবানবন্দীতে বলেছেন, ২০ মে আকাশের কাছ থেকে ভয়েস বার্তায় তিনি জানতে পারেন, ১২ হাজার ডলার মুক্তিপণের জন্য আকাশকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া এবং রড দিয়ে পেটানো হচ্ছে। পরে তিনি তানজিদুলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে আকাশের জন্য তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। পরে ২৮ মে গণমাধ্যমে জানতে পারেন মুক্তিপণ না পেয়ে আকাশকে হত্যা করা হয়েছে। এর জন্য তানজিদুলকে দায়ী করেন নাজির হোসেন।
দেশে সক্রিয় ১৮ মানব পাচারকারী চক্র : সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, লিবিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে দেশের ১৫ জেলার ১৪ চক্রের ৩ শতাধিক ব্যক্তি জড়িত। প্রতিটি চক্রে অন্তত ২৫ জন করে সদস্য সক্রিয় আছেন। মানব পাচার চক্রগুলো ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, বরগুনায় সক্রিয় রয়েছে।
রাজধানীতে মানব পাচারে মোঃ কামালউদ্দিন ওরফে হাজী কামাল (গ্রেফতার), খালিদ চৌধুরী, আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি চক্র সক্রিয় আছে। এ ছাড়া মানব পাচারে পুরানা পল্টনের স্কাই ভিউ ট্যুরস এ্যান্ড ট্রাভেলসের নাম এসেছে। ওই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহীন বাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শাহীনের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার কুলপদ্দী গ্রামে।
মাদারীপুরে মানব পাচারে সক্রিয় আছেন নূর হোসেন শেখ, নজরুল, রবি, জুলহাস শেখ, মিরাজ হাওলাদার, রাসেল মীর, রাজন ওরফে বুলেট, মোমিন, ইলিয়াছ মীর, জাকির মিয়াসহ ২৫ জনের একটি চক্র।
গোপালগঞ্জে সক্রিয় আছে রব মোড়লের নেতৃত্বে, কুষ্টিয়ায় মোঃ কামালের নেতৃত্বে, ফরিদপুরের বক্স সরদারের নেতৃত্বে, নড়াইলে মোক্তার মোল্লার নেতৃত্বে, কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শাওন ও জাফর ইকবালের নেতৃত্বে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রফিকুল ইসলাম (সেলিম) ও হোসাইনের নেতৃত্বে, কুমিল্লার সনাতন দাশ ওরফে দাদা, শরীফ হোসেনের নেতৃত্বে, শরীয়তপুরের রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে, বরগুনায় সজল ও ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে, নোয়াখালীতে রুবেল মির্জা, নাসির উদ্দিন মির্জা ও রিপন মির্জার নেতৃত্বে একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। হেলাল মিয়া, খবির উদ্দিন ও শহিদ মিয়ার নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। আশিকের নেতৃত্বে একাধিক চক্র মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানব পাচারে সক্রিয় আছে। আশিকের (২৫) বাড়ি কেরানীগঞ্জের পার গেণ্ডারিয়ায়। তিনি এসএসসি পাস। ২০১৯ সালে কেরানীগঞ্জে অবস্থান করে মানব পাচারে যুক্ত হন। ২০ থেকে ২৫ জনের একটি মানব পাচার চক্র গড়ে তোলেন। আশিকের পাচারকারী চক্রে রয়েছেন মামি সিমা আক্তার, খালা হেলেনা বেগম ও পলি আক্তার। গত ১০ জুলাই রাতে পুলিশ আশিককে গ্রেফতার করে। দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচারকারী তিন চক্রের (গাজী, কাজী ও বাবুল) হোতা রুবেল মিয়া হলেন আশিকের মামা। রুবেলের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড় ভাটারায়।
গাজী, কাজী, বাবুল চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে চাকরিপ্রত্যাশীদের ইউরোপের ইতালিতে নেয়ার জন্য সাত-আট লাখ টাকা করে নেন। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের প্রথমে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন থেকে চার লাখ টাকা নেয়া হয়।
৯ জন ফেরত এসেছে : মানবপাচার নিয়ে কাজ করা সিআইডির বিভাগটি বলছে, গত বছর লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের কাছ থেকে অপহরণের শিকার হন একদল বাংলাদেশী। পরে তাদের হাতেই খুন হন এক অপহরণকারী। এর প্রতিশোধ নিতেই ক্ষিপ্ত অন্য পাচারকারীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় আরও ১২ বাংলাদেশী আহত হয়। তাদের মধ্যে ৯ জন বিভিন্ন সময় ফেরত এসেছে। বাকি তিনজন এখনও সে দেশে কাজ করছেন।
১১ জনের খোঁজ নেই : র্যাব জানায়, গত দুই বছরে মামা রুবেল ও ভাগ্নে আশিক চক্র ৮০ জনকে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মাদারীপুরের নিখোঁজ দুজনের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব অনুসন্ধান চালিয়ে এই পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায়। তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে ৮ লাখ করে ১৬ লাখ টাকা নেয়া হয়। লিবিয়ার মিজদাহে হতাহত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে আশিক চক্র সে দেশে পাচার করেছিল। লিবিয়ায় তানজিলুর ওরফে তানজিমুল ওরফে তানজি ও আবদুল্লাহর নেতৃত্বে আরেকটি চক্র সক্রিয় আছে।
রেড নোটিশভুক্ত চার মানব পাচারকারী অধরা : গত বছরের নবেম্বরে লিবিয়ায় মানবপাচার মামলার ৬পলাতক আসামিকে ধরে দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ পুলিশ সংস্থার (ইন্টারপোল) সাহায্য চেয়েছিল সিআইডি। সিআইডির অনুরোধে রেড নোটিস জারি করে বাংলাদেশ পুলিশ। নোটিস দেয়ার দেড় মাসের মধ্যে দুই বাংলাদেশী মানব পাচারকারী গ্রেফতারও হন। এরপর ৬ মাস কেটে গেলেও বাকি চার আসামি মিন্টু মিয়া, স্বপন, নজরুল ইসলাম মোল্লা ও তানজিরুলের খোঁজ দিতে পারেনি পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
বিপজ্জনক জলপথ : সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবিতে বাংলাদেশীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই। গত ২১ জুলাই লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়। এর আগে গত ২৪ জুন ভূমধ্যসাগর থেকে ২৬৪ বাংলাদেশীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। গত ২৮ ও ২৯ জুন নৌকায় অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ৪৩ জন নিখোঁজ বা মৃত্যু হয়। ২০১৪ সাল থেকে এ পথে ইউরোপে যেতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের ২০ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরেই মারা গেছেন অন্তত ৩৫০ জন। ভূমধ্যসাগরের এ জলপথকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য ‘বিপজ্জনক পথ’ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ
মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেছেন, মানব পাচার চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে লিবিয়ায় মানব পাচার করছেন। লিবিয়ায় সক্রিয় কয়েকটি মানব পাচার চক্র ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে ঝুঁকিপূর্ণ মানব পাচার করছে। তিনি বলেন, প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে যাঁরা টাকা ফেরত পান, তাঁরা মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আগ্রহী হন না। কিছু ব্যক্তি মামলা করলেও মানব পাচারকারীর পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেন না। মানব পাচারের অভিযোগে দায়ের করা ২৪ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত বাকি ১৩৫ মানব পাচারকারীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বাকি একটি মামলার তদন্তও শেষ পর্যায়ে।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তথ্য যাচাই-বাছাই না করে সহজ উপায়ে লিবিয়া ও ইউরোপ যেতে গিয়ে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, সারাদেশে মানব পাচারে সহস্রাধিক ব্যক্তি জড়িত।
দালাল ধরা পড়লে মানব পাচার বন্ধ হবে না : অভিবাসন খাতের বেসরকারী গবেষণা সংস্থার কর্মকর্তাদের মতে, আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গীবাদ যেভাবে দমন করা হয়েছে, মানব পাচার প্রতিরোধে তেমন শক্ত উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই মানব পাচার নিয়ন্ত্রণে আসবে। মানব পাচারের ঘটনায় সাধারণত দালাল ধরা পড়ে। দালাল ধরা পড়লে মানব পাচার বন্ধ হবে না। তাঁদের মাধ্যমে পাচারকারীর মূল ঘাঁটিতে পৌঁছাতে হবে। পুলিশ যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাঁরা দালাল কি না দেখতে হবে। তাঁরা যদি দালাল হন, তাহলে মানব পাচার বন্ধ হবে না। এ ছাড়া মানব পাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাগুলোর বিচার করলে পাচারকারীরা ভয় পেতে পারেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিসহ শূন্য সহনশীলতা নীতি (জিরো টলারেন্স) অবলম্বন করলে মানব পাচার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে অভিবাসন সংস্থার গবেষকদের দাবি।