কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে আগামী নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, বিএনপিকে কে ভোট দেবে? কারা, কেন, কোন সুখের স্বপ্নে বা কোন আশার আলো দেখে বিএনপিকে ভোট দেবে? একটা দল কীভাবে জিতবে, তার নেতৃত্বটা কোথায়? একজন এতিমের টাকা চুরি করে সাজাপ্রাপ্ত আসামি, আরেকজন গ্রেনেড হামলার মামলায় কারাদণ্ড নিয়ে দেশান্তরি, সাজাপ্রাপ্ত আসামি। জনগণ কোন ভরসায় ওই দলকে ভোট দেবে? আসলে বিএনপি জানে যে নির্বাচনে তাদের আর কোন সম্ভাবনা নেই, সে কারণেই তারা নির্বাচন বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।
সোমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬ততম অধিবেশনে অংশগ্রহণ পরবর্তী জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন। ’৭৫ পরবর্তী জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে নির্বিচারে সামরিক বাহিনীর অফিসার-সৈনিকসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা, লাশ গুমের ঘটনায় একটি কমিশন গঠনের দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবৈধ ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে জেনারেল জিয়া প্রায় দুই হাজারের মতো সামরিক বাহিনীর অফিসার-সদস্যকে হত্যা করেছে। এ বিষয়ে কিছু একটা হওয়া উচিত, জনগণকে আরও সোচ্চার হওয়া উচিত।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে অপর এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, কোন কোন সংস্থা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী করে রাখতেই বেশি পছন্দ করে বলে তাঁর মনে হয়েছে। মনে হয় রিফিউজি পালাটা (পালন করা) একটা ব্যবসা কোন কোন সংস্থার জন্য। রিফিউজি না থাকলে তাদের চাকরিই থাকবে না, এটাই হলো আসল কথা। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচনকে নির্বাচন হিসেবেই দেখি। কখনও আত্মতুষ্টিতে ভুগি না, জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন এবং তাদের ভোট নিয়েই ক্ষমতায় আসতে চাই। জনগণ ভোট দিলে আসব, নইলে আসব না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনী, স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ তাদের দোসর কিছু দল আছে তাদের ষড়যন্ত্র থাকবে সেটা আমি জানি। বারবার তো আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মরি না কী করব? তবে মৃত্যুর ভয়ে কখনও আমি ভীত নই। যতক্ষণ শ্বাস আসে ততক্ষণ দেশের মানুষের সেবা ও কল্যাণ করে যাব। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবই। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের মাধ্যমে নাকি সার্চ কমিটির মাধ্যমে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকা সাংবাদিকরা প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টাব্যাপী অসংখ্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিমাখা মুখে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলন সোয়া দুই ঘণ্টারও বেশি স্থায়ী হয়।
সংবাদ সম্মেলনে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএম আব্দুল মোমেন ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। প্রধানমন্ত্রী শুরুতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গণভবন থেকে সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
করোনার কারণে সব সাংবাদিককে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন না করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আশা করছি দ্রুতই সবাইকে (সাংবাদিক) নিয়ে বসে কথা বলতে পারব। করোনার সময় আজকে বসলাম, আমার মনে হয় উসুল উঠে গেছে আজকে সংবাদ সম্মেলনে। হাসতে হাসতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত সময় চেয়েছেন, আমি তত সময় দিয়েছি। যত প্রশ্ন করেছেন সব উত্তর দিয়েছি। কাজেই করোনার এই দেড়-দুই বছরে বসতে পারিনি, সেটার কিন্তু উসুল উঠে গেছে।
কোন সুখের স্বপ্নে বিএনপিকে ভোট দেবে? : বিএনপির নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, কারা কেন কোন সুখের স্বপ্নে বা কোন আশার আলো দেখে বিএনপিকে ভোট দেবে? সেটাও একটু জিজ্ঞেস করেন, জেনে রাখি। জনগণ ভোট দিতে পারছে না বলে যারা অভিযোগ করছেন, তাদের কে ভোট দেবে, সেও প্রশ্ন উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, জনগণ কখন ভোট দেয়? মানুষ যখন দেখে ওই দলকে ভোট দিলে ক্ষমতায় কে যাবে। তাঁরা (বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমান) ইলেকশনও করতে পারবে না। বিএনপি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলেছে মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, তারা জানে যে তাদের কোন সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা যখন নেই, যেভাবে হোক নির্বাচনটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা, অর্থাৎ গণতন্ত্রের যে ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে, সেটা নষ্ট করা। সাংবাদিকদের সামনে রেখে তিনি বলেন, তাদের (বিএনপি) ভোট দেবে কেন- এই প্রশ্নটা করেন না। জনগণ ভোট দিতে পারছে নাÑ এই কথাটা যারা বলে, মানুষ তাদের ভোট কেন দেবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি জানে যে তাদের আর কোন ‘সম্ভাবনা নেই’, সে কারণেই তারা নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত করার চেষ্টা’ করছে। এখন অনেক নির্বাচন হচ্ছে। করোনার মধ্যেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিচ্ছে। যারা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে সেই দলটির জন্মটা কোথায়? সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারীর হাতে তৈরি এই দল (বিএনপি)। ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তো কোন প্রশ্ন উঠেনি। ওই নির্বাচনে বিএনপি জিততে পারল না কেন?
’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছর এবং পরবর্তী বিএনপির ৫ বছর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর মিলিয়ে এই ২৮ বছরে দেশের কী হয়েছে আর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ১৭ বছরে দেশের আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তার একটা তুলনামূলক বিচার করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির আমলে হত্যা-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-গ্রেনেড হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, দেশকে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছে। পাকিস্তানী কায়দায় দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে। মুসলমান-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ কোন সম্প্রদায়ের মানুষ নেই যারা ওই সময় নির্যাতনের শিকার হয়নি। এই দলকে (বিএনপি) দেশের জনগণ কেন ভোট দেবে? দেশের জনগণ কার কাছ থেকে কি পেয়েছে তার বিচার করেই ভোট দেবে।
রোহিঙ্গা অর্থাৎ রিফিউজি যেন ব্যবসা : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার তাগিদ দেয়ার পরও আশাব্যাঞ্জক সাড়া না পাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন কোন সংস্থা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী করে রাখতেই বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়েছে তাঁর। মনে হয় রিফিউজি পালাটা একটা ব্যবসা কোন কোন সংস্থার জন্য। রিফিউজি না থাকলে তাদের চাকরিই থাকবে না। এটা হলো আসল কথা। তিনি বলেন, অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকাণ্ডে মনে হয়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তাদের খুব বেশি আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে একটা জিনিস মনে হয়, রিফিউজি থাকলে কিছু লোকের মনে হয় লাভই হয়। অনেক প্রস্তাব আসে রোহিঙ্গাদের জন্য এখানে অনেক কিছু করে দিতে চায়। আমি সোজা বলে দিই, যান মিয়ানমারে, ওখানে ঘর করেন, স্কুল করেন, এখানে করা লাগবে না। আমার কাছে যেটা মনে হয়, (তাদের কাছে) সব কিছুই যেন একটা ব্যবসা। অনেক সংস্থা আছে, যারা রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে বরাবারই ভাল সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু সংস্থা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে সেই আগ্রহ দেখায় না।’
বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার এই চাপে কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, সে কথা জাতিসংঘে তুলে ধরার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেখানে নানা ধরনের অসঙ্গতি চলছে, নারী পাচার, শিশু পাচার, সবচেয়ে বড় ড্রাগ, এই ড্রাগ পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা (রোহিঙ্গারা)। যেটা আমাদের জন্য সবচেয়ে আশঙ্কাজনক। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলছি, এটা সেখানে হচ্ছে, আরও হবে, যদি প্রত্যাবাসন না হয়।
বাংলাদেশ টিকা উৎপাদন করতে প্রস্তুত : করোনার ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে অপর এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, এটা খুব দুর্ভাগ্য মানবজাতির জন্য যে, প্রতি সময় আমরা দেখি যেকোন একটা মহামারী আকারে দেখা দিলে সেখানে কিছু শ্রেণী আছে তারা তাদের আর্থিক লাভ-লোকসানটার দিকে যতবেশি তাকায়, ঠিক মানুষের দিকে ততটা তাকায় বলে আমার মনে হয় না। এটা শুধু আমার দেশে বলে না, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এটা আমরা লক্ষ্য করি। যে কারণে এটাকে (টিকা) আমি সর্বজনীন করার জন্য বলেছি। শুধু তাই না আমি এটাও বলেছি বাংলাদেশ টিকা তৈরি করতে প্রস্তুত। এ ব্যাপারে খুবই আশাবাদী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ১০ একর জায়গা নিয়ে রেখেছি। সার্বিক ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে গাভির (টিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট) সঙ্গে আলোচনা করেছেন, ডব্লিউএইচওর (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আমরা বলেছি আমরা ফর্মূলা চাই। আমরা সিড চাই এবং আমরা বাংলাদেশে এটা (টিকা তৈরি) উৎপাদন করতে পারব। আলোচনার পর আমরা আশার কথা শুনেছি এবং আমরা টিকা উৎপাদনের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী।
করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এইটুকু বলব যে, আমরা চেষ্টা করেছি। আমি বাংলাদেশের মানেুষের কাছে কৃতজ্ঞ এই কারণে যে, যখনই আমরা আহ্বান করেছি করোনা মোকাবেলা করার জন্য যা যা করণীয়, তাঁরা যেন সেটা পালন করে। অনেক সময়, প্রথমদিকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এখন সবাই অন্তত সেটা মেনে চলে। এমনকি টিকা নেয়ার পরও কিন্তু মাস্কটা পরে রাখা বা একটু দূরত্ব রাখা বা হাতটা পরিষ্কার রাখা, এটা কিন্তু করা উচিত। এটা করতে হবে। এটা করলে পরে আরও অনেকটা এগুতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার সবসময় লক্ষ্য ছিল দেশের মানুষের জন্য কাজ করা। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমরা সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু করোনা এসে কিছুটা বাধা দিয়েছে। তারপরও এমন ব্যবস্থা করলাম যে, গ্রামে যেন অর্থ সরবরাহ হয়। উন্নত দেশগুলোতে কী পরিমাণ খাদ্যাভাব, তা অনেকেই জানেন না। সব খবর পত্রিকায় আসে না। কিন্তু আমি জানি ভেতরের অবস্থা কি। সেখান থেকে সবাইকে খাদ্য উৎপাদন চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছি, যেন অভাব না হয়। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। ত্রিশ লাখ মানুষকে ডিজিটাল মাধ্যমে একসঙ্গে নগদ সহায়তা দিতে পেরেছি। এত সুবিধা পেয়েও গালিটা আবার আওয়ামী লীগের ওপর দিয়েই যাচ্ছে। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কারণ বাঙালির চরিত্রেই আছে- কেউ ভাল করলে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে হবে।
ই-কমার্সে প্রতারণার শাস্তি অবশ্যই হবে : মানুষের দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে যারা ই-কমার্সসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ টাকা বানানোর জন্য যে প্রতারণাটা করে, এটার শাস্তি অবশ্যই হবে। আমরা বসে নেই, সঙ্গে সঙ্গে এদের ধরা হয়েছে। একবার যখন ধরা হয়েছে তখন তারা টাকাগুলো নিয়ে কোথায় রাখল, কী করল, কী সম্পদ বানাল সেটাও কিন্তু খুঁজে বের করা হবে।
সরকারপ্রধান এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু করার আমরা কিন্তু সব করেছি। এ ধরনের হায় হায় কোম্পানি যখন সৃষ্টি হয়, আপনাদের সাংবাদিকদের একটা দায়িত্ব থাকে এই নিয়ে। সবার ওপরেই আপনাদের একটা শ্যেন দৃষ্টি থাকে। তাই এ ব্যাপারেও আপনাদের মনে হয় একটা দায়িত্ব আছে। যদি শুরুতেই আপনারা ধরিয়ে দিতে পারেন যে, এই কোম্পানিগুলো হায় হায় কোম্পানি বা এখানে প্রতারণা করছে বা এরা প্রতারক। অন্যদিকে মানুষও যদি একটু সতর্ক হয় তাহলে এ ধরনের সমস্যা কিন্তু হয় না। জনগণের টাকা ফিরে দেয়ার চেষ্টা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, যেই টাকাগুলো তারা নিয়ে নিয়েছে, তারা কোথায় টাকা রেখেছে, কোথায় পাচার হয়েছে- সেই ব্যাপারগুলোরও তদন্ত হচ্ছে। যখনই এগুলো পাওয়া যাবে, আমরা সেগুলো ফেরত দেয়ার চেষ্টা করব। যেমন আমরা খালেদা জিয়ার ছেলে কোকোর পাচার করা কিছু টাকা ফেরত এনেছিলাম। আরও এরকম বহু টাকা আছে আমরা ফেরত আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তালেবান উত্থানে ভয়ের কিছু নেই : আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে যেন জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাস যেন আবার ফিরে না আসে সেজন্য সরকার সতর্ক রয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন, তালেবানের উত্থানে ভয়ের কিছু নেই। যেকোন অবস্থা মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা আমরা রাখি। তবে আফগানিস্তানের বাতাস কোনভাবেই যেন আমাদের দেশে আসতে না পারে সেজন্য আমরা যথেষ্ট সতর্ক রয়েছি। আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ধরে রেখে এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর আল-কায়েদার উত্থান হলে বাংলাদেশ থেকে অনেকে আফগানিস্তানে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। প্রধানমন্ত্রী ওই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, বহু লোক তখন সেখানে ট্রেনিং নিয়ে আসে, অর্থ সম্পদ বানিয়ে নিয়ে আসে। আমরা কিন্তু সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের বিষয়গুলোকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে এনেছি। একটা দুটা ঘটনার পর অনেকে ভেবেছিল, আমরা তা সমাধান করতে পারব না। কিন্তু আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।
জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এই জঙ্গীবাদ কখনও মঙ্গল বয়ে আনে না, শান্তি নষ্ট করে, উন্নয়নকে ব্যাহত করে, সে কথা বোঝাতে হবে। আর এখন দেশের মানুষ এ ব্যাপারে খুবই সচেতন। কিছু হলে জনগণই এখন খবর দেয়। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারোর সঙ্গে বৈরিতা নয়- এই পররাষ্ট্রনীতি নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি, তাই এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।
জিয়ার আমলে গণফাঁসির বিষয়ে তথ্য বের করা দরকার : ’৭৫ পরবর্তী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর জিয়াউর রহমানের আমলে ক্যু-পাল্টা ক্যুর নামে নির্বিচারে সামরিক বাহিনীর অফিসার-সদস্যদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা এবং গুমের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্তে কমিশন গঠনের দাবির বিষয়ে করা প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ পরবর্তী ক্যু-পাল্টা ক্যুর নামে বিমানবাহিনীসহ সামরিক বাহিনীর অসংখ্য অফিসার-সদস্যকে বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন কারাগারে খোঁজ নিলেই ওই সময়ে কত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, লাশ গুম করা হয়েছে- সেই তথ্য পাওয়া যাবে।
কমিশন গঠনের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এত বছর পরে হলেও মানুষের মধ্যে চেতনা এসেছে। জেনারেল জিয়া তার অবৈধ ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীকে হত্যা এবং লাশ গুম করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার বিএনপি কিন্তু করেনি। কথিত বিদ্রোহের একটা বিচারের নামে ৯ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এটার অবশ্যই একটা তদন্ত হওয়া দরকার। বিমানবাহিনীসহ পুরো সামরিক বাহিনীর প্রায় দুই হাজার সদস্যকে জিয়ার আমলে হত্যা করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত, আরও জনমত গঠন হওয়া দরকার।
বিলাসিতায় ব্যস্ত, গবেষণায় নয় ॥ গবেষণা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা তো রাজনীতিবিদ; আমি তো আর মডেল না। আমাদের মডেলের মতো সবসময় সাজতে হবে কেন? এখন সবাই মডেল হতে চায়, সমস্যা এইখানেই। এটাই সমস্যা হয়ে গেছে আমাদের দেশে। বিলাসিতার জন্য এত বেশি নজর হয়ে গেছে গবেষণার কাজে নিজের সময়টা নষ্ট করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের গবেষণার ওপর গুরুত্বরোপ দেয়ার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং গবেষণা ছাড়া কোন দেশের উন্নতি করার সম্ভব না বলে মন্তব্য করেন।
গবেষণার জন্য তাঁর সরকার আলাদাভাবে অর্থ বরাদ্দ, স্পেশাল ফান্ড করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। তাদের সময়টা আবার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে আবার আরেকটা টাকা পায়। কিন্তু ওই সময়টা গবেষণার কাজে লাগায় না। আবার যারা করেন না, তাঁরাও কিন্তু গবেষণায় খুব একটা বেশি মনোযোগ দেন না।
এসময় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবলমাত্র পোস্ট গ্রাজুয়েশন এবং গবেষণার কাজে চিকিৎসকদের জন্য করা হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসকরাই গবেষণা কাজে অনীহা দেখান। তাঁরা প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতালে গিয়ে অপারেশনসহ ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখেন। তিনি বলেন, আমার উদ্দেশ্য ছিল, এই মেডিক্যাল বিজ্ঞানে গবেষণার করা। কিন্তু খুব কম হাতেগোনা কয়েকজন গবেষণা করে। যারা গবেষণা করে দুই চারজন মাঝে মাঝে কথা বলি। আমি ঠিক বুঝি না, এখানে এই অনীহাটা কেন? আমি সত্যি কথা বলছি এবং এটাই হলো বাস্তবতা। এখন যদি খালি টাকা কামাইটা চিন্তা হয় তাহলে আর গবেষণা করবে কিভাবে? এই জবাবটা আমি কিভাবে দেব? আপনারা একটু সোচ্চার হন, তখন যদি কেউ মনোযোগ দেয়।
সরকারপ্রধান বলেন, গবেষণার জন্য যথেষ্ট ফান্ড আছে, কিন্তু শুধু উদ্যোগের অভাব। মনের ভেতরে আসলে ওই একটা ওই যে বড়লোক হবো, টাকা বানাব। ভাল থাকব। এই বানাব, এবং গাড়িতে চড়বো; দৃষ্টি সেই বিলাসিতার দিকে! সামরিক স্বৈরশাসকরা যখনই কোন দেশের ক্ষমতায় আসে তখন বিলাসিতার দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। আমাদের দেশে কিন্তু এটা ছিল না। আমাদের দেশের মানুষরা আদর্শ নিয়ে চলত। সেই আদর্শটা কিছু কমে গেছে, এখন বিলাসিতার দিকেই দৃষ্টি চলে গেছে বেশি। বিলাসিতার জন্য এতো বেশি নজর হয়ে গেছে যে, সময়টা নষ্ট করতে পারে না। কারণ টাকার লোভটা আর মায়াটা একটু বেশি হয়ে গেলে সমস্যাটা দেখা দেয়। তবে পরিবর্তন হবে, আমি তো বললাম, এর পরিবর্তন আসবেই।
ইংলান্ডে বঙ্গবন্ধুর নাতনি সংসদ সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকের ওপর হামলার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইংল্যান্ডে বঙ্গবন্ধুর নাতনি ব্রিটিশ সংসদ সদস্য টিউলিপের ওপর হামলার ঘটনায় তারাই ব্যবস্থা নেবে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। ইংল্যান্ডের মতো সভ্য দেশেও যুদ্ধাপরাধীরা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। কিছু লোক তো ওখানে বসে আছে, এটা দুঃখজনক। আমরা কিছু বলতে চাই না। ব্রিটিশ সরকার এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের দেয়া ঘরে ভাঙ্গন প্রসঙ্গে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন ঘর ভাঙল আপনারা ভাঙ্গা ঘরের ছবি দিলেন। ঘরটা দেখেন তো এটা ম্যাটেরিয়ালের জন্য ভেঙ্গেছে নাকি ভাঙ্গা হয়েছে? সেটি খুঁজে বের করুন। ভাঙ্গা ঘরটা দেখলেন, কারা ভাঙল তা দেখলেন না। সারা দেশে গরিব ও অসহায় লোকদের জন্য সরকার ঘর তৈরি করে দেয়। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম দেশে কেউ ঘর ছাড়া থাকবে না। পৃথিবীর একটি দেশ দেখান যারা একসঙ্গে ৭০ হাজার পরিবারকে দুই কাঠার জমিসহ ঘর অর্থাৎ নিজস্ব ঠিকানা দিতে পেরেছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী হাতুড়ি-শাবল দিয়ে কিছু ঘর ভাঙ্গার আলোকচিত্র তুলে ধরে বলেন, যারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের অনেককে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আর যারা দুর্নীতি করেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।