কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রতারণার কৌশল হিসেবে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো টাঙ্গিয়ে রাখতেন বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপের এমডি মোঃ রফিকুল আমীন। মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ডিসি-এসপিদেরও ব্যবহার করেছেন রফিকুল আমীন। তাদের সঙ্গে ছবি তুলে জেলা ও উপজেলাসহ সব অফিসে বড় বড় করে টাঙ্গিয়ে রাখতেন তিনি। নতুন গ্রাহক-পরিবেশকদের আস্থা অর্জনের জন্য এ ছিল তার কৌশল। অর্থাৎ সহজ-সরল মানুষদের বোঝাতো যে এত বড় বড় প্রভাবশালী মানুষ ডেসটিনির সঙ্গে আছেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যবসায়ের অংশীদার করে, মাসোহারা দিয়ে এবং সেধে গিয়ে বড় বড় ক্রীড়ানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্পন্সর করাও ছিল ডেসটিনির আরেক কৌশল। মুম্বাইয়ের চিত্রনায়ক শাহরুখ খান ও নায়িকা রানী মুখার্জীকে দেশে এনে অনুষ্ঠানও করেছিল ডেসটিনি।
এমনকি মন্ত্রী, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, উপ-উপাচার্য, ফুটবলার, অধ্যাপক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও উচ্চপদস্থ সামরিক- বেসামরিক ব্যক্তিদের দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করিয়েছে ডেসটিনি। শুধু ডেসটিনিই নয়, যুবক, ইউনিপেটুইউ, এইমওয়েসহ বেশ কিছু এমএলএম কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন দেশের বিত্তবান কিছু লোকজন। দীর্ঘ সময় পর অভিনব প্রতারণার এমন যাত্রায় শামিল হয়েছে দেশের ই-কমার্স খাতের কিছু কোম্পানিও। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, ধামাকাসহ বেশ কিছু কোম্পানি ক্রিকেট, নাটক-সিনেমা কিংবা সঙ্গীত অঙ্গনের তারকাদের সামনে রেখে ই-কমার্স ব্যবসার নামে আত্মসাত করেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। কৌশলে জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সরও ভাগিয়েছে এসব কোম্পানি। অর্থের বিনিময়ে পেয়েছে কিছু দেশী ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স ব্যবসায় অবিশ্বাস্য সব অফারের সঙ্গে ছিল চটকদার বিজ্ঞাপন। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে ই-কমার্সের নামে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত বেশ কয়েকটি ‘প্রতারক’ প্রতিষ্ঠানের ফাঁদ ছিল এমনই। তাদের নানা আয়োজনে সব অঙ্গনের নামীদামী তারকাদের ভিড় ছিল নিয়মিত দৃশ্য। তার মধ্যেও আলাদা ছিল ক্রিকেটার ও ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গড়ে তোলার চেষ্টা। সাধারণ ভোক্তারা বলছেন, তারকা ক্রিকেটারদের দেখেই ই-কমার্স থেকে যে কোন পণ্য কিনতে আগ্রহী হতেন তারা। তবে এতে ক্রিকেটারদেরও পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না বুঝে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন তারা। পরে সাধারণ ক্রেতাদের তোপের মুখে পড়তে তো হচ্ছেই, ঘটছে বাড়ি ঘেরাও করার মতো ঘটনাও।
সম্প্রতি প্রতারণা করে গ্রাহকের এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। ভুঁইফোড় এই কোম্পানির শুভেচ্ছা দূত ছিলেন মাশরাফি। যদিও এর মেয়াদ জুলাই মাসে শেষ হয়ে গেছে। এর পরও মাশরাফির বাসার সামনে কিছু গ্রাহক বিক্ষোভ করেলে তিনি প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের মামলায় সহায়তা করেছেন। এছাড়া এসপিসি ওয়ার্ল্ড নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। ই-অরেঞ্জের ভুক্তভোগী গ্রাহক মোহাম্মদ রাব্বিল হাসান বলেন, ‘আমি সরকারের ই-কমার্স নীতিমালা প্রকাশের আগে ই-অরেঞ্জের ডাবল টাকা ভাউচার কিনেছিলাম। কিন্তু তারা আমার মতো অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমরা অনেকেই ই-অরেঞ্জের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসাডর মাশরাফি বিন মর্তুজাকে দেখেই অর্ডার করেছিলাম। ভেবেছিলাম মাশরাফি নিশ্চয় দেখেশুনে খারাপ কোম্পানিতে যুক্ত হননি। এখন সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কা করছি।’
জানতে চাইলে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপি বলেন, ‘আমি যদি জানতাম ই-অরেঞ্জ প্রতারণা করবে, তাহলে কি আর তাদের শুভেচ্ছা দূত হতাম? এগুলো আসলে আমাদের জানার সুযোগ নেই। কেউ কি বলে আমি প্রতারণা করব, আপনি আমাদের দূত হন?’ ঘরোয়া-আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও জনপ্রিয় বাঁহাতি কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমান। খেলার পাশাপাশি পছন্দের নানা বাইক আছে মুস্তাফিজের সংগ্রহে। ধামাকা শপিং ডটকম থেকে নিজের পছন্দের হোন্ডা রেপসল মডেলের বাইক কিনে ফেসবুকে দিয়েছিলেন তিনি। ফেসবুকে এই ছবি দেখে মোস্তাফিজ ভক্তরা বাইক কিনে বিপাকে পড়েছেন। দীর্ঘ ৬ মাসেও ধামাকা থেকে বাইক পায়নি এমন গ্রাহকের সংখ্যা দুই শতাধিক।
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান রহমান খানকে গত ১০ মার্চ শুভেচ্ছা দূত হিসেবে যুক্ত করেছিল ইভ্যালি। দুই বছরের জন্য তিনি ‘ফেস অব ইভ্যালি’ হিসেবে কাজ করবেন বলে চুক্তি করেন। তবে গত মে মাসেই ইভ্যালি ছেড়ে দিয়েছেন বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন তিনি। চুক্তির সময় কিছু টাকা পেলেও পরবর্তী দুই মাসে প্রতিষ্ঠানটি থেকে কোন অর্থ পাননি বলে তিনি দাবি করেন।
এছাড়া অভিনেত্রী রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা ইভ্যালির ‘ফেস অব ইভ্যালি লাইফস্টাইল’ শুভেচ্ছাদূত হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ইভ্যালিতে নানা জটিলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে দেন তিনি। মিথিলা জানান, ইভ্যালির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে নানা জটিলতা দেখতে পাই। এরপর চুক্তিটি বাতিল করি। আমি চাই না এই সময়ে ইভ্যালি রিলেটেড কোন খবরে আসতে। আরও অনেক কাজ আছে, সেগুলো নিয়েই এখন ব্যস্ত আমি। অন্যদিকে অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া প্রতিষ্ঠানটির প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিন মাস আগে। ফারিয়া জানিয়েছেন এক মাস আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। শবনম ফারিয়া বলেন, ‘প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর অফিসিয়ালি তিন মাস কাজ করলেও কোন বেতন আমি পাইনি। আমি যোগদানের পর থেকেই জানতে পারি ভেতরে বেতন নিয়ে সমস্যা চলছিল। তাই তিন মাস কাজের পরই আগস্টের শেষ সপ্তাহে আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসি।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ব্র্যান্ডের মুখপাত্র কিংবা এ্যাম্বাসেডররা কোম্পানির আইনগত বিষয়গুলো দেখে সাধারণত চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু আইনের বাইরেও আরও কথা থেকে যায়। কোম্পানিটি সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ কি না, নেতিবাচক এমন কিছু করছে কি না, যা মানুষের ক্ষতি করছে। চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাস পর দেখা গেল সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ড একটা প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম করল। এতে এ্যাম্বাসেডরের আইনগত দায়বদ্ধতা না থাকলেও নৈতিক দায় থেকে যায়। কোন কিছু এনডোর্স করলে অবশ্যই তা বিশ্বাস করা উচিত। বিশ্বাসের সঙ্গে না গেলে সেই কাজ করা উচিত না। আমাদের এখন সময় এসেছে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ হওয়ার। আইন ও নৈতিকতার মাঝে একটা বড় জায়গা আছে, সেটা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমার কারণে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, আমি হয়তো তার দায়ভার নেব না। কিন্তু আমি না থাকলে হয়তো অনেক মানুষ যেত না।’