কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরকারী পাটকল বন্ধ হয়ে গেলেও পাটের দামে কোন প্রভাব পড়েনি। এক বছরের বেশি সময় ধরে সরকারী ২৫টি পাটকল বন্ধ থাকলেও পাটের দামে এবার কৃষকের মুখের হাসি আরও চওড়া হয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় পাটের বেশ ভাল দাম পাচ্ছেন কৃষক। বছরের কেনাবেচাও শুরু হয়েছে চড়া দামেই। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৩৫০০ টাকায়। কোথাও কোথাও চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা দামেও প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত দামে পাট বিক্রি হয়নি।
কৃষক এখন পাট নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কোথাও খাল-বিল, পুকুর কিংবা ডোবায় পাট কেটে জাগ দেয়ার জন্য ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। আবার হাইওয়ে কিংবা গ্রামীণ রাস্তার পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে সারি সারি করে শুকাতে দেয়া হয়েছে পাট। কোথাওবা আবাদকৃত পাটগাছ কেটে জাগ দিয়ে সেখান থেকে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ আঁশ ছাড়ানো পাট শুকিয়ে ঘরে তুলছেন। গ্রামাঞ্চলে গেলে এখন একটাই দৃশ্য চোখে পড়ে সোনালি পাট নিয়ে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণীরা। অনেক জায়গায় সড়কের দুই পাশে নারী ও পুরুষকে পাট শুকানোর কাজ করতেও দেখা যায়। আবার অনেকে অটোরিক্সা, ভ্যান, ভটভটি দিয়ে বাজারে পাট নিয়ে যাচ্ছেন। নদীতে যেমন সারি সারি পাটের নৌকা, তেমনি সড়কেও সারি সারি পাটের অটোরিক্সা, ভ্যান, ভটভটি। ফলে নতুন পাটের গন্ধে এখন গ্রাম-গঞ্জ মাতোয়ারা।
এ বছর পাটের বীজ বপন ও পরবর্তী কিছুদিন খরা দেখা দেয়ায় পাটের জমিতে কৃষকদের ১-৩টি অতিরিক্ত সেচ দিতে হয়েছে। তবে পরবর্তীতে বৃষ্টিপাত ভাল হওয়ায় পাটের ভাল ফলন হয়েছে এবং কর্তনকৃত পাট সহজেই জাগ দিতে পারছেন। তবে উত্তরাঞ্চলের কোন কোন স্থানে পানি না থাকায় পাটগাছ জাগ দিতে কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়েছিল কৃষকদের। পরবর্তীতে বৃষ্টি হওয়ায় সেই সমস্যা কেটে গেছে। ঠিকমতো পাট কেটে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে শুকিয়ে সেই পাট এখন বাজারে বিক্রির ধুম পড়েছে।
দেশে পাটকল বন্ধ হলেও বিশ্বব্যাপী এ প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে বাড়ছে রফতানিও। পাশাপাশি পাট দিয়ে এখন বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে। ফলে দেশেও পাটপণ্য উৎপাদন হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। সব মিলিয়ে পাট নিয়ে এখন আর কৃষকের দুশ্চিন্তা নেই। বরং পাট বিক্রি করে কৃষক এত মুনাফা পাবেন কোন দিন চিন্তাই করতে পারেননি। এক সময়ে দেশে যেখানে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়ার জন্য কৃষকের পক্ষ থেকে দাবি উঠত, সেখানে এখন শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়ার দাবি উঠছে। এতে বুঝাই যাচ্ছে, পাটের বাজার এখন কৃষকের। কৃষকরাও বলছেন, বাজারে পাট বিক্রি করে তারা বেজায় খুশি। পাটের বদৌলতে এবার দুটো পয়সা তাদের ঘরে এসেছে। গতবারের চেয়ে মণে প্রায় হাজার টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে পাট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের হাটবাজারে এখন প্রতিমণ ভাল মানের পাট তিন হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আর খারাপ মানের পাটের দরও আড়াই হাজার টাকার ওপর। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত দামে পাট বিক্রি হয়নি।
যদিও কাঁচা পাটের দাম ‘অস্বাভাবিক’ বেড়ে যাওয়ায় খুশি নন বেসরকারী পাটকল মালিকরা। তারা বলছেন, এত বেশি দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। এতে দেশে পাট পণ্যের উৎপাদন কমে যাবে।
গত কয়েক বছর ধরেই পাটের দাম ভাল যাচ্ছে। এর মধ্যে গত বছর (২০২০ সাল) পাটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পাটকাটা মৌসুমের শুরুতেই প্রতিমণ পাট বিক্রি হয় ২ হাজার থেকে ২২শ’ টাকা দরে। পরে এটি ৩৫শ’ এবং মৌসুমের শেষ পর্যায়ে হাটে প্রতিমণ পাটের দাম ৫ হাজার টাকা পৌঁছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর প্রতিমণ পাটের গড় মূল্য হয়েছিল ৩৫শ’ টাকা।
বেজায় খুশি কৃষক : পাট চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাট চাষ করে তিন মাসের মধ্যে পাট ঘরে তোলা যায়। কম সময়ে, কম পরিশ্রমের ফসল পাট। প্রতি বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ মণ পাট উৎপাদন হয়। তবে কোন কোন অঞ্চলে প্রতি বিঘায় ১৫ মণ পর্যন্ত এ বছর পাট উৎপাদন হয়েছে। এবার বাজারে পাটের মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। দু’একটি জেলায় প্রতিমণ পাট সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। এত দামে বিক্রির কারণে পাট চাষের খরচ বাদ দিলে অভাবনীয় মুনাফা পাচ্ছেন পাট চাষীরা।
দেশের সব জেলায়ই কম-বেশি পাটের চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়। এ জেলার মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষে বিশেষ উপযোগী। এ কারণে ফরিদপুরের পাট ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এ জেলায় এখন প্রতিমণ নতুন পাট বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৮০০ টাকা। এই দাম পেয়ে জেলার কৃষকরা বেজায় খুশি। এই দামে পাট বিক্রি করে সালথা সদর উপজেলার কৃষক লিয়াকত সিকদার বেজায় খুশি। মুখের হাসিটা আরও চওড়া করে তিনি বলেন, ‘এর আগে কখনোই এত দামে পাট বিক্রি করিনি।’
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঝে তা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা বাড়ায় ২০১০-১৫ সাল নাগাদ চাষের এলাকা বেড়ে ৭ লাখ হেক্টরে পৌঁছায়। এরপর থেকে তা আরও বাড়ছে। আগে ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখন ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানান।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাত লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়। সেখান থেকে ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার টন পাট উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ছয় লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল, সেখান থেকে ৮০ লাখ টন পাট পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছয় লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। সেখান থেকে ৮০ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়।
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মোঃ আইয়ুব খান বলেন, ‘দেশে পাটকল বন্ধ হলেও বিশ্বব্যাপী এ প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে রফতানি বাড়ছে। পাশাপাশি দেশেও পাটপণ্য উৎপাদন হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।’
এবার পাটের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এত দাম দীর্ঘসময়ে ছিল না। গত দুই বছর থেকে পাটের দাম খুব ভাল যাচ্ছে। এতে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে পাট আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে উৎপাদনও।’
তিনি বলেন, ‘সারাদেশে এ বছর পাটের উৎপাদন ৮০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বেশ বেড়েছে। যদিও গত বছর ঘূর্ণিঝড় আমফানে পাটের বেশ ক্ষতি হয়। এ বছর প্রথমে খরার কারণে সমস্যা হলেও পরে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় পাটের উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া প্রতি বছরই নতুন নতুন চাষী যুক্ত হচ্ছেন পাটের সঙ্গে।’
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার পাটের ভাল ফলন হয়েছে। কৃষকরা বর্তমান পাটের বাজার দর অনুযায়ী উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ভাল লাভ পাচ্ছেন। পাটের দাম এ রকম থাকলে আগামী বছর কৃষকরা আরও ব্যাপকভাবে পাট চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন।