হতাশা কাটছে শিক্ষার্থীদের ॥ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার খবরে সবাই উচ্ছ্বসিত

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঠিক দেড় বছর আগে মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শঙ্কায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষার মধ্যেই সীমিত ছিল শিক্ষা কার্যক্রম। এই সময়টাতে নিজের বিদ্যালয় বা কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের মাটির ঘ্রাণ পায়নি কোন শিক্ষার্থী। দিনের পর দিন ঘরবন্দী থেকে তাদের পার করতে হয়েছে একঘেয়েমি জীবন। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী। সময় কাটাতে নির্ভরতা তৈরি হয় ভার্চুয়াল মাধ্যমে। ঘরবন্দী জীবনে যখন নাভিশ^াস তাদের তখনই ঘোষণা এলো খোলা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আবারও শিক্ষার্থীদের কোলাহলে ভরে উঠবে শিক্ষাঙ্গন। এই খবরে উচ্ছ্বসিত দেশের প্রায় সব এলাকার সব শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উচ্ছ্বাস তখনই স্থায়ী হবে যখন তাদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের পাশাপাশি আনা হবে টিকার আওতায়।
করোনার সংক্রমণের ভয়ে দেড় বছরের প্রায় পুরোটাই ঘরবন্দী অবস্থায় কাটায় সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী স্বর্ণ। সম্প্রতি এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে কলেজে গিয়ে আবেগে কান্না চলে এসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এতটা সময় আমাদের বয়সীরা কিভাবে ঘরে বসে কাটিয়ে দিতে পারে? কি কষ্ট হয়েছে তা আমরাই জানি। টেলিভিশন দেখে আর মোবাইল দেখেও কাটানো যায় কত সময়? উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির পর মাত্র কয়েকদিন ক্লাস করেছি। কলেজ জীবনের কোন স্বাদই পাইনি। অবশেষে কলেজ খুলছে। ধন্যবাদ সরকারকে। আবারও স্কুলে যেতে পারবে এই আনন্দে উচ্ছ্বসিত ৮ম শ্রেনীর ছাত্রী তাথৈ। আনন্দমাখা কণ্ঠে বলেন, ঘরবন্দী অবস্থায় যে দিন কাটায় সেই জানে কি কষ্ট। আবারও বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হবে, প্রিয় শিক্ষকদের ক্লাস করতে পারব। কি যে আনন্দ হচ্ছে।
এদিকে স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণার পরপরই স্কুলব্যাগ, স্কুল ড্রেস তৈরির দর্জির দোকানগুলোতে বেড়েছে ভিড়। স্কুলব্যাগ কিনতে আসা নাফিসা হুমায়ুন বলেন, করোনায় আমাদের খুব কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে। তাই আমাদের জীবনের অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। নিয়মিত স্কুলে না যাওয়ায় এবং মা-বাবা দুজনেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় ঘরের অনেক কিছুই ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। খুঁজে পাচ্ছি না স্কুলব্যাগটিও। তাই স্কুলব্যাগ কিনতে মাকে নিয়ে মার্কেটে এসেছি।
টেইলার্সে মেয়ের স্কুলের নতুন ড্রেস বানাতে এসেছেন রহিমা বেগম। তিনি বলেন, আমার মেয়ে ৩য় শ্রেণী থেকে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে স্কুলে আর যেতে হয়নি। তাই স্কুল ড্রেসও পরা হয়নি। দীর্ঘদিন আলমারি বন্দী থেকে থেকে ড্রেসগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে। তাই নতুন ড্রেস বানাতে এসেছি।
রবিবার ১২ তারিখ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। আগের ঘোষণা অনুযায়ী এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানান তিনি। এছাড়া, বর্তমানে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ‘রিওপেনিং’ (পুনরায় ক্লাস চালু করা) পরিকল্পনা তৈরি করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও এ নিয়ে বেশকিছু সুপারিশ দিয়েছে।
তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা, বন্যাদুর্গত এলাকা, উচ্চসংক্রমিত জেলা, শিখন ঘাটতি দূর করা, ঝরে পড়া, স্থানান্তরিত ও স্কুলবিহীন শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনা।
বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় বছর বন্ধ থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। ঝোঁপঝাড়ে ছেয়ে গেছে শ্রেণীকক্ষ। বাথরুমসহ ওয়াস ব্লক নষ্ট হওয়ার পথে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। খোলার পর ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণও কঠিন বলে দাবি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এএএমএস আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, স্কুল-কলেজ খোলার এই সিদ্ধান্তটিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। ছাত্রছাত্রীরা প্রায় ১৭-১৮ মাস স্কুল-কলেজে যায়নি। সরকার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ৫ শতাংশ সংক্রমণের হার এ আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে ৫ শতাংশের নিচে নামলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হবে। কিন্তু যেহেতু তা হয়নি তাই প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনও কমবেশি ১০ শতাংশ। ১০-১৫ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী এবং ১৮ বছরের বেশি বয়সী বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এখনও টিকা পায়নি। যদি স্কুলে-কলেজে একজন শিক্ষার্থীও করোনায় আক্রান্ত হয় তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সেই স্বাধীনতা দিতে হবে যেন তাৎক্ষণিকভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আক্রান্ত শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা দেয়াসহ অন্য ব্যবস্থা নেয়ার। কারণ জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই।
এদিকে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১৩ জেলায় চলছে বন্যা। বেশ কিছু জেলায় সংক্রমণের হার অনেক বেশি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে জ্ঞানগত ঘাটতি। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। তাদের মধ্যে কারও বিয়ে হয়ে গেছে, আবার কেউ অর্থ উপার্জনের কাজে জড়িয়ে গেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা সত্যি খুবই কঠিন। তবু শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাহসী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা এটিকে সাধুবাদ জানাই উল্লেখ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, ছেলেমেয়েদের আবারও স্কুল-কলেজে যাওয়ার সুযোগ হবে। এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। তবে আগের মতো আর আমাদের স্কুল চালানো যাবে না। একটি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের একদিন স্কুলে আনা ও তাদের তিন ভাগে বসানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক দূরত্ব। রাজধানীতে মানুষজন সচেতন থাকলেও মফস্বল বা গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সপ্তাহে ৫ দিন বা ৬ দিনের পরিবর্তে কমিয়ে আনা যায় কিনা সেটা ভাবতে হবে। শিক্ষকরা নিয়মিত আসলেও শিক্ষার্থীদের একদিন পর পর আসার উদ্যোগ নিতে হবে।
এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানো সত্যি একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। একটা শিক্ষার্থীর জীবন থেকে দেড় বছর বছর চলে যাওয়া অনেক বড় ক্ষতি। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব না। তবে সরকার যেহেতু একটা পদক্ষেপ নিয়েছে তাই সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে আমাদের শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে। সবকিছুর চাইতে জীবন বড়।
তবে যেহেতু করোনার সংক্রমণ কম আছে তাই অভিভাবকদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, আমাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ করোনা সংক্রমণের নিম্নগতি ধরে রাখাও। তাই প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গেটে তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজেশন করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। এই সময়টায় আবার রয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপও। তাই শিক্ষাঙ্গন পরিচ্ছন্ন রাখাটাও জরুরী। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোথাও জমানো পানি না থাকে। না হলে করোনা না হোক ডেঙ্গুতেও আমাদের শিশুরা আক্রান্ত হতে পারে। তাই সতর্কতার বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে আশ^স্ত করেছেন স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, ১২ বছরের ওপরের শিশুদেরও প্রয়োজনে করোনার টিকা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৪ আগস্ট এক আলোচনাসভায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বৈশ্বিক সঙ্কটের শুরু থেকে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত না করে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে যেন কাজ করি। আমরা এখন পর্যন্ত সেটাই করছি। তারা যেন পড়াশোনায় পিছিয়ে না পড়ে, এ জন্য নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেছি। এসময় ধাপে ধাপে খোলার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় বেশি। কারণ এ অসুখে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সবাই শুরু থেকেই সপ্তাহে ৬ দিন হয়তো ক্লাস করার সুযোগ পাবে না। একটু সময় নিয়ে হবে সেটা।
করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েক বার চেষ্টা করেও এই মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর খোলা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দ্রুত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ পর্যন্ত গত ১৭ মাসে দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি বাড়ানো হয়েছে। করোনা সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় সবশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান সাধারণ ছুটি ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়।