সতর্ক না হলে বিপদ ॥ করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু কমলেও হেলাফেলার সুযোগ নেই ॥ তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও তৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। গত মাসের তুলনায় করোনা পরিস্থিতির আপাত দৃষ্টিতে উন্নতি ঘটলেও যেকোন সময়ে ফের অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। অফিস আদালত সব কিছু খুলে দেয়ায় জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি পালনে জনগণের উদাসীনতা এবং সচেতনতার অভাবে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। করোনা সংক্রমণ কমায় জনগণের আত্মতুষ্টিতে আগামীতে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে ভাইরাসটি।
এপ্রিলের পর থেকে টানা লকডাউন ও সরকারের টিকাকরণ কর্মসূচীর পরিধি বাড়ানোর কারণে গত কয়েকদিন ধরে অব্যাহতভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে যাওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরেছে। নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে দেশে করোনা শনাক্তের হার কমায় মাস্ক পরিধানসহ করোনা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বর্তমানে অনীহা দেখা যাচ্ছে। কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও টিকার আওতায় আসেনি। তাই জনগণের এই সাময়িক তৃপ্তি যেকোন মুহূর্তে বিষাদে রূপ নিতে পারে।
ইতোমধ্যে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ উন্নত বিশ্বে করোনার তৃতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। এছাড়া ইউরোপের দেশগুলোতে ডেল্টা ধরনের কারণে করোনার তৃতীয় ঢেউ এসেছে বলে মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় দুর্বল এ্যান্টিবডির মানুষের জন্য টিকার বুস্টার ডোজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আগামী অক্টোবর মাসেই আঘাত হানতে পারে করোনার তৃতীয় ঢেউটি। ভারতে মূলত করোনার ডেল্টা প্লাস ভাইরাসের দ্বারাই ঢেউটি আসবে বলে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের (এইমস) বিজ্ঞানীরা মত দিয়েছেন। তাদের মতে, ডেল্টা প্লাসে শিশু ও কিশোররা বেশি ঝুঁকিতে থাকবেন, কারণ তারা টিকার আওতার বাইরে থাকছেন। তাই ভারতের মতো বাংলাদেশেও ডেল্টা প্লাসের কারণে করোনার নতুন ঢেউ আসার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি পালনে উদাসীনতা ও সব কিছু খুলে দেয়ায় দেশে ডেল্টা প্লাসের বিস্তার ঘটার আগেই তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে।
দেশের স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানা এক মাসের অধিক সময়ের জন্য জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের সময় সরকারী-বেসরকারী অফিস আদালত ও কলকারখানাসহ গণপরিবহন বন্ধ থাকার সুফল হিসেবে ধীরে ধীরে সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যা কমেছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং মাস্ক পরার কারণে করোনাভাইরাসের চেন ভাঙ্গা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ থেকে সরে আসে। বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছুই খুলে দেয়া হয়েছে।
এদিকে করোনা সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। তবে সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যেন এই ভাইরাসে সংক্রমিত না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বরাবরই স্বাস্থ্যবিধির জায়গাটিকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থে বিষয়টি সমন্বয় করে স্বাস্থ্য অধিদফতর পরামর্শ দিচ্ছে। অধিদফতর মনে করে এই দুটি দিক প্রাধান্য দিলে নিরাপত্তার জায়গাটিতে আশ্বস্ত হওয়া যাবে। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি।
তবে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরাতে উদ্যোগের কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে নতুন সঙ্কটে পরার আশঙ্কা করছেন তারা। তাদের মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে।
তারা বলছেন, মাসখানেক আগেও দৈনিক ১৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত ও আড়াই শ’ জনেরও বেশি মৃত্যুর রেকর্ড হয়। তবে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দৈনিক ১১৪ জনের মৃত্যু এবং নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৬৬ জন। এতে সহজেই বোঝা যায় যে, দেশে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত কমে এসেছে। কিন্তু সংক্রমণ ও মৃত্যু হ্রাসে মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ঢিলেঢালাভাব দেখা যাচ্ছে। ফলে আপাতভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু নিম্নমুখী হলেও আবার তা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। কারণ ঢিলেঢালাভাবের কারণেই ডেল্টাতে নতুন করে ব্যাপক আকারে সামাজিক সংক্রমণের ঘটনা ঘটতে পারে।
অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা নিয়ে গত ১১ আগষ্ট সরকার লকডাউন শিথিল করার পর সারাদেশে অফিস আদালত, গণপরিবহন, ছোট-বড় মার্কেট-শপিংমল ও বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে খুলতে শুরু করেছে। জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে। করোনাকে মেনে নিয়েই তাদের পেটের তাগিদে রাস্তায় নামতে হচ্ছে। তবে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে ঢিলে ঢালাভাব করোনাকে ফের উস্কে দিতে পারে।
স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনের সুফল ধরে রাখতে হলে ঘরের বাইরে মানুষকে মাস্ক পরিধান, ঘন ঘন সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলার মতো বিষয়গুলো শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের চলমান টিকাদান কর্মসূচীতে নিবন্ধন করে টিকা নিতে হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারলে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত তা না হয়, ততদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
গত মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে ২ কোটি ৪২ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৬ জনকে করোনা টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে করোনার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১ কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার ৪৭৯ এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৬৯ লাখ ৭৬ হাজার ৩১৭ জন। প্রথম ডোজ টিকা গ্রহীতার মধ্যে পুরুষ ৯৯ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৪ আর নারী ৭২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪৫ জন। দ্বিতীয় ডোজ টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে পুরুষ ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৩ আর নারী ২৬ লাখ ৭৬ হাজার ৩৫৪ জন। সরকারের গণটিকা কর্মসূচী সফলভাবে এগিয়ে চললেও দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশটি টিকার বাইরে রয়ে গেছেন। তাই কোনভাবেই বর্তমান পরিস্থিতিতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা আগের তুলনায় কমেছে। কোন কোন স্থানে করোনা সংক্রমণ নেই এমনভাবে অনেকেই মুখে মাস্ক পরিধান না করেই অবাধে চলাফেরা করছেন। পাড়া-মহল্লাতে দলবদ্ধ হয়ে আড্ডায় মাতছেন তরুণরা। সাধারণ মানুষের মুখে মাস্ক থাকলেও অনেকেই সেটির সঠিক ব্যবহার করছেন না। কেউ মাস্ক নাকের নিচে নামিয়ে রাখছেন, কেউবা ঝুলিয়ে রাখছেন কানের পাশে। অনেকেই জামার পকেটে মাস্ক রাখছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে পড়লে তারা মাস্ক পরছেন।
কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের আগে গণপরিবহনগুলোতে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখার কড়া নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেটির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ গাড়ির হেল্পার ও ড্রাইভার মাস্ক সঠিকভাবে পরছেন না। চরম উদাসীনতা রয়েছে যাত্রীদের মধ্যেও। আসনের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে গণপরিবহনে। মার্কেট কিংবা শপিংমলগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতারা মাস্ক না পরেই পণ্যের দরদাম ও বেচাকেনা করছেন।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, লকডাউনের ফলে সংক্রমণ কমলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে আবার তা বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তিনি করোনা সংক্রমণ রোধে শতভাগ মানুষকে মাস্ক পরিধানের পরামর্শ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইলোরোজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডাঃ প্রফেসর সায়েদুর রহমান বলেন, শুধু একটি মাস্কেই করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ ভাইরাসটি নাক, মুখ ও চোখ দিয়েই শরীরে প্রবেশ করে। তাই জনগণ শুধু মাস্ক ব্যবহার করেই করোনাকে প্রতিরোধ করতে পারে। তাই লকডাউন তুলে দেয়ার পর জনগণকে অবশ্যই মাস্ক পড়তেই হবে। নইলে যেকোন সময়ে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে।