কাজিরবাজার ডেস্ক :
রোহিঙ্গাদের হত্যা ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত করে বিতাড়নের নেপথ্যে যে নীল নকশা প্রণীত হয়েছিল তা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধান তদন্ত, স্যাটেলাইটে চিত্র ধারণের মাধ্যমে উদ্ঘাটিত হয়েছে বহু আগে। জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা যে শ্রেণীরই হোক না কেন- এরা সেদেশের নাগরিক। অথচ জাতিসত্তার সেই নাগরিকত্ব মিয়ানমার সরকার কেড়ে নিয়েছে। এ কাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে সেদেশের সামরিক বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে জড়িতদের বেআইনী ও বর্বরোচিত নানামুখী অবৈধ কর্মকান্ড।
বিশ্বব্যাংক আকস্মিকভাবে বিবৃতি দিয়ে জানাল বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের পর আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে হয়েছে উল্লাস। আর কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ মনোভাবের বহিঃর্প্রকাশ। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসার পর বিশ্বব্যাংক ৩ আগস্ট তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে জানান দিয়েছে এ ধরনের সুপারিশ বাংলাদেশের প্রতি তারা করেনি। করেছে ইউএনএইচসিআর (ইউনাইটেড হাইকমিশন ফর রিফিউজি)। ফলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে এ বিষয়টি নিয়ে পিছু হটার বিষয়টি প্রতিভাত।
বর্তমানে মিয়ানমারে, বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিলে রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান রয়েছে। সেই হিসাবে এর অর্ধেকই বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় রয়েছে। সরকার পক্ষে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এই জনগোষ্ঠী সদস্যদের আশ্রয়দানের এমন মানবিকতার বিপরীতে আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা, এদেশের উন্নয়ন সহযোগী কিছু সংস্থা, দেশী-বিদেশী এনজিও সংস্থা এমনকি উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদে বিশ্বাসী এমন রোহিঙ্গারা এখন এদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক। ওরা এদেশে আশ্রিত। ওরা রিফিউজি নয়। এটাই সরকারীভাবে স্বীকৃত। অথচ এদেশেরই কিছু মহল এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আশ্রিত এসব রোহিঙ্গাকে ‘শরণার্থী’ নামে অভিহিত করার প্রবণতা লক্ষণীয়। যা কখনও কাম্য হতে পারে না। কেননা ‘শরণার্থী’ আর ‘আশ্রিত’ এ দুটি শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী মিয়ানমারের একসময় রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু সেদেশের এনএলডি (ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি) নেত্রী আউং সান সুচি সরকার এবং বর্তমান সামরিক জান্তা সরকার সেদেশে এবং এর পাশাপাশি বিশ্ব ফোরামে এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতারা এদেশে এসেও কখনও ‘রোহিঙ্গা’ নামটি উচ্চারণ করেনি। যা রোহিঙ্গাদের জন্য বড়ই দুঃখজনক। এর মূল কারণ অনুসন্ধানে জানা যায় মিয়ানমার প্রমাণ করতে চায় ওরা মূলত বাঙালী। এদেশ থেকে ওরা মিয়ানমারে গিয়ে বসতি গেড়েছে। হোক না তা শত বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে। এটাও তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার উচ্ছিষ্ট একটি অংশ। তারা বিষয়টি বিশ্বমহলে যে কোনভাবে গিলাতে চায়। আবার ইতোমধ্যে আশ্রিতদের ক্ষুদ্র একটি অংশকে মিয়ানমার থেকে এদেশে এসেছে বলে স্বীকার করেছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে এ ক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে অপর বৃহৎ অংশটি কি মিয়ানমার থেকে আসেনি?
মূলত এরা সকলেই সেদেশেরই নাগরিক এবং সেদেশের সংসদেও রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে নাগরিকত্ব না থাকলে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে কিভাবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গা নামটি উচ্চারণ করতে নারাজ। কারণ এ নাম তাদের মুখে উচ্চারিত হলে থলের বেড়াল বেরিয়ে যায়। নিজেদের পাতা জালে নিজেরাই ধরা পড়ে যায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী বহু দেশ সোচ্চার। সাহায্য ও সেবামূলক সংস্থাগুলোও তৎপর। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন, গণহারে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি ঘটনাবলি নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ এখনও সর্বোচ্চভাবে না হলেও একেবারে কম হয়েছে তাও বলা যাবে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী ধিকৃত হয়েছেন আউং সান সুচি। সেদেশের বহু সেনা কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনাও রয়েছে। এছাড়া পশ্চিম আফ্রিকার ক্ষুদ্র একটি দেশ গাম্বিয়া রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও দায়ের করেছে। আদালত প্রাথমিকভাবে গণহত্যার বন্ধের নির্দেশনা প্রদান করেছে। এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলমান। চূড়ান্ত রায় অপেক্ষাধীন।
কিন্তু এইএনএইচসিআরের পক্ষে এ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশে কোন বক্তব্য এখনও আসেনি। এই সংস্থাটি রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘ সময় ধরে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। গোটা কক্সবাজারজুড়ে এদের কার্যক্রম বিস্তৃত। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য অনুযায়ী ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ নিয়ে রিফিউজি ইস্যুতে যে প্রস্তাব রেখেছে তা বাংলাদেশের জন্য যে হতে পারে না তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে জানান দিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক তাদের বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা বাংলাদেশকে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে এর পুরোটাই অনুদান। শরণার্থী সংক্রান্ত রূপরেখার পর্যালোচনার ব্যাখ্যায় বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে ইউএনএইচসিআরের আরপিআরএফ অনুসরণ করে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে ‘রিফিউজি পলিসি রিফ্রম ফ্রেমওয়ার্ক’ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক। ব্যাংকের ঢাকা দফতর থেকে বাংলাদেশকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এ ব্যাপারে মতামত দিতে সময় দেয়া হয়। পরে এ সময় বাড়িয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য, মানবিক সহায়তার কথা বললেও নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কোন সাহায্য সংস্থা বা এনজিও এ জাতীয় ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট যে হয় না তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে সহায়তার অর্থের অর্ধেকই খরচ করা হয় নিজেদের স্বার্থে। নিজেদের জন্য খরচ হবে এতে কোন বাধা নেই। তবে এর সীমারেখা কী তা কোনভাবেই জানা যায় না। অর্থাৎ যে যেভাবে ইচ্ছে করে তাই তারা সম্পন্ন করতে তৎপর থাকে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে অর্থ সহায়তা সংক্রান্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত ২ আগস্ট সাংবাদিকদের কাছে এটাও জানান দিলেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে দাতারা সরাসরি কোন অর্থ সরকারকে দেয় না। তাদের নামে যে অর্থ আসে এর চেহারাও সরকার দেখে না। তারা অর্থ আনে, তারাই খরচ করে। কিভাবে খরচ করে তাও জানায় না। দেখভাল করার সুযোগও দেয়া হয় না। কি বিস্ময়কর ব্যাপার!
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোপন বৈঠক : এপিবিএনের সাঁড়াশি অভিযান : এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পিছু হটা এবং বিষয়টি ইউএনএইচসিআরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ছিল বিক্ষুব্ধ। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর মঙ্গলবার রাতে রোহিঙ্গা নেতারা সন্ত্রাসীদের নিয়ে উখিয়া কুতুপালং, বালুখালি ও জামতলীতে গোপন বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে ৩০ বছর আগের পুরনো রোহিঙ্গাদেরও অংশগ্রহণ ছিল। এ খবর পেয়ে এপিবিএন (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) সদস্যরা অভিযান চালায়। অভিযানের খবর পেয়ে গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা পাহাড়ী পথে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন সামগ্রী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এ জাতীয় বৈঠক আশ্রিত ভিনদেশীরা করতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের বিপরীতে সরকার পক্ষে নাকচ বা প্রত্যাখ্যান করার ঘটনায় স্থানীয়রা উল্লসিত। স্থানীয় গোফর উদ্দিন চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ভারে উখিয়া টেকনাফের জনপদ বিপদগ্রস্ত হয়ে আছে। এদের সকলকে উখিয়া টেকনাফ থেকে সরিয়ে অন্য স্থানে নেয়া সময়ের দাবি। কেননা মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা উখিয়া টেকনাফে এদের অবস্থান সার্বিক পরিস্থিতিকে গোলাটে করে তুলছে। মিয়ানমার থেকে যেসব মাদক অস্ত্র গোলাবারুদ এমনকি স্বর্ণের চোরাচালান সবই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এদের অবস্থানের দূরত্ব ভাসানচরের বাড়ানো হলে অনেক সুফল বয়ে আসবে। এরা উখিয়া টেকনাফের ব্যাপক বনজ সম্পদ ধ্বংস করে দিয়েছে। পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে বসতি গেড়েছে। বিদেশীদের প্রস্তাব অনুযায়ী কক্সবাজারের মূল স্রোতের সঙ্গে একীভূত করার ঘটনা কখনও মেনে নেয়া হবে না।
পলায়ন অব্যাহত : বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের পলায়ন অব্যাহত রয়েছে। গত এক সপ্তাহে ক্যাম্প ত্যাগকারী ২৫০ রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে। রামুর রশিদনগর এলাকায় ফের আটক হয়েছে ৩২ রোহিঙ্গা। মঙ্গলবার সকালে এদেরকে আটক করা হয়। রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণয়ন চাকমা জানান, এদের কাছ থেকে অর্থ ও মোবাইল সেট জব্দ করা হয়েছে। এর আগে গত ২৬ জুলাই জোয়ারিনালায় ধরা পড়ে ১৩৯ রোহিঙ্গা। ২৫ জুলাই ৭৮ এবং ২৪ জুলাই ৩০ রোহিঙ্গা ধরা পড়ে। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা সুযোগ বুঝে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে তৎপর। উল্লেখ্য, উখিয়া টেকনাফে ৩৪ ক্যাম্পে এদের আশ্রয় দেয়া হয়। বর্তমানে একটি ক্যাম্প বন্ধ করে ৩৩ করা হয়েছে।