কাজিরবাজার ডেস্ক :
কঠোর বিধিনিষিধ শিথিল করায় বৃহস্পতিবার থেকে বাস, ট্রেন, বিমান ও লঞ্চ চালুর ঘোষণায় যেন যাত্রীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। মঙ্গলবার থেকেই এসব পরিবহনের টিকেট কাটার ধুম পড়ে গেছে। সাজ সাজ রব পড়ে গেছে রাজধানীর বাস-টার্মিনাল, রেল স্টেশন, বিমান অফিস ও লঞ্চ টার্মিনালে। একদিকে ধোয়া মুছা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ- অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রীদের টিকেট বিক্রির প্রস্তুতি। বাস ট্রেন বিমান ও লঞ্চ চালু করার সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানিয়েছেন, আজ বুধবার রাত থেকেই ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবে দূরপাল্লার বাস। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে চলবে সিটি সার্ভিস থেকে শুরু করে সব ধরনের গণপরিবহন। রেল সূত্র জানিয়েছে অর্ধেক আসন খালি রেখে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে আন্তঃনগর ও মেইল মিলিয়ে ৫৭ জোড়া ট্রেন চলাচল করবে। আকাশপথের সবগুলো গন্তব্যেই চালু করা হবে বিমান। ঢাকা থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর রাজশাহী, যশোর বরিশালে যাবে বিমান, ইউএস বাংলা ও নভো এয়ারের ফ্লাইট। এসব রুটে একাধিক ফ্লাইট চালাবে প্রতিদিন এ তিনটে এয়ারলাইন্স। বৃহস্পতিবার থেকে আগামী শুক্রবার সকাল পর্যন্ত চলবে এসব পরিবহন। এয়ারলাইন্সগুলো জানিয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীদের বেলায় কোন ধরনের ব্যত্যয় ঘটবে কিনা আদেশে সেটা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। শুক্রবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত লকডাউনের শিথিলতার সময়সীমা ঘোষণা করা হলে আকাশপথের বেলায় কিভাবে তা মানা হবে এ বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। সেক্ষেত্রে এয়ারলাইন্স্গুলো চাইছে অন্তত শুক্রবার সারাদিন ফ্লাইট চালাতে
বাস : কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছে দূর পাল্লা ও স্বল্প পাল্লার বাস চালানোর প্রস্তুতি। নগরীর মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গাবতলী টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়- ব্যাপক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত চালক ও শ্রমিকরা। আজ বুধবার রাত থেকেই এসব টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাবে দেশের সব রুটের বাস। মঙ্গলবার আগাম টিকেট কাটতেও দেখা গেছে। গত দু সপ্তাহ ধরে টার্মিনালে অলস বাসগুলো বসে থাকার পর পরিষ্কার করা হচ্ছে। অনেক বাসেই তোলা হয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও স্প্রে। বিধিনিষেধে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় এ খাতের শ্রমিকরা পড়েছিলেন বিপাকে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালুর দাবিও জানিয়ে আসছিলেন তারা। এখানকার পরিবহন শ্রমিক রুবেল বলেন, সরকারের কঠোর লকডাউনে আমরা বিপদে পড়েছি। টানা লকডাউনে পরিবার নিয়ে না খেয়ে দিন পার করেছি। আমি নিজেও অনেক দিন না খেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয়নি। আমরা কাজ করলে টাকা পাই আর সেই টাকা দিয়েই সংসার চালাই। কিন্তু এতদিন লকডাউনে আমাদের কেউ খোঁজ-খবর রাখেনি। প্রত্যেক পরিবহন মালিকই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে গাড়ি কিনেছে। পরিবহন মালিকরা নিজেরাই ঠিক মতো ঋণের টাকা দিতে পারে না। তাহলে আমাদের দেবে কিভাবে। শাহ আলম নামে একজন বাসচালক বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তে আমরা খুশি। করোনায় মরে গেলে যাব, কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। খুব কষ্টে দিন পার করছি। পুরো পরিবার নিয়ে অসহায়ভাবে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের আয় বন্ধ ঠিকই, কিন্তু পরিবারের খরচ তো আর বন্ধ নেই। গাবতলীতে দেখা যায়, দূরপাল্লার বাসগুলো পরিষ্কার করার কাজ চলছে। গাড়িগুলো ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখে নিচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। এছাড়া অনেক গাড়ি মেরামতের কাজও করছেন মালিকরা।
মহাখালীতে গিয়ে দেখা যায় ঢাকা কিশোরগঞ্জ রুটে অনন্যা পরিবহন সহ উত্তরবঙ্গে রুটে একতা, এনা ও সাদিকা পরিবহানের বাসগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির সব শর্ত নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় সব কাজ চলছে। অনন্যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরান রশীদ তুহিন জানান-প্রতিটি সিটেই দেয়া হবে স্বাস্থ্যবিধির সব উপকরণ। এক আসন ফাঁকা রেখেই চালানো হবে বাস।
ট্রেন : দু সপ্তাহ ট্রেন বন্ধ রাখার পর বৃহস্পতিবার থেকে ট্রেন চালুর ঘোষণার পর থেকেই কমলাপুর রেল স্টেশনে কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ে। অনলাইন টিকেট বিক্রি সিস্টেম হালনাগাদ করা হয়। মঙ্গলবারই মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়- টিকেট বিক্রির কথা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার শরিফুল আলম জানান, পবিত্র ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে চলমান বিধিনিষেধ ১৫ থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। তাই মঙ্গলবার বিকেল সন্ধ্যা থেকে অনলাইনে টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। আর ১৫ জুলাই থেকে থেকে ৩৮ জোড়া আন্তঃনগর ও ১৯ জোড়া মেইল ট্রেন যাত্রা শুরু করবে।
রেল সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৫০ শতাংশ আসন খালি রেখে থেকে ট্রেন চলাচল করবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে অনলাইনে টিকেট বিক্রি শুরু হয়। তবে ট্রেনে কোন রুটেই ভাড়া বাড়ানো হয়নি। এবার মাস্ক পরিধান ছাড়া কাউকেই রেলস্টেশনে ঢুকতে দেয়া হবে না। এ বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারোয়ার বলেন, কমলাপুর রেলস্টেশনে মাস্ক পরিধানে আরও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি আমরা। জীবাণুনাশক ব্যবহার ও তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থাও জোরদার করা হচ্ছে। কাউন্টারে টিকেট বিক্রি করা হবে না। রেলপুলিশসহ আমাদের সকল সংস্থার জনবল পুরোপুরি ও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজে লাগানো হবে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ট্রেনের টিকেট শুধু অনলাইনেই বিক্রি হবে। নন কম্পিউটারাইজড স্টেশনের টিকেট ওই স্টেশন কাউন্টার থেকে কেনা যাবে। অনলাইনে ক্রয় করা টিকেট ফেরত দেয়া যাবে না। কমিউটার ট্রেনের টিকেট যথারীতি নির্দিষ্ট বক্স কাউন্টার থেকে দেয়া হবে। আসনবিহীন টিকেট বিক্রি করা হবে না। টিকেটবিহীন কোন যাত্রী স্টেশনে প্রবেশ বা ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবেন না। ট্রেনে প্রতিনিয়ত বিশেষ চেকিং অভিযান চালানো হবে। বিনা টিকেটে ট্রেন ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকার জন্য রেলওয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। ট্রেনে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দরজা ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ না করার অনুরোধও করেছে রেলওয়ে। ট্রেনে চড়তে হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে। মাস্ক ব্যতীত কোন যাত্রীকে স্টেশনে প্রবেশ বা ট্রেনে ভ্রমণ করতে দেয়া হবে না।
জানা গেছে, ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীদের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, প্রতিটি ট্রেনের টিকেট অনলাইনে বিক্রি করা হবে। নন কম্পিউটারাইজড স্টেশনের টিকেট ওই স্টেশন কাউন্টার থেকে কিনতে হবে। সব অগ্রীম টিকেট যাত্রার পাঁচ দিন আগে যাত্রীরা কিনতে পারবেন। অনলাইনে কেনা টিকেট ফেরত দেয়া যাবে না। কমিউটার ট্রেনের টিকেট যথারীতি নির্দিষ্ট বক্স কাউন্টার থেকে দেয়া হবে। টিকেটবিহীন কোন যাত্রী স্টেশনে প্রবেশ বা ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবেন না।
বিমান : অন্যান্য পরিবহনের মতোই অভ্যন্তরীণ রুটের বিমান চলাচলও শুরু হচ্ছে বৃহস্পতিবার থেকেই। এ বিষয়ে বেবিচকের সদস্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী জিয়াউল কবীর জানান, আগের নির্দেশনা মতোই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চালাতে হবে ফ্লাইট। প্রতিটি এয়ারলাইন্স নিজের অনুমোদিত শ্লট অনুযায়ী ফ্লাইট চালাবে। চলবে শুক্রবার পর্যন্ত।
এদিকে বিমান নভো ও ইউএস বাংলা জানিয়েছে, তারা তাদের নিজস্ব পলিসি অনুয়ায়ীই অনলাইনে টিকেট বিক্রির প্রস্তুতি নিয়েছে। আজ বুধবার থেকেই টিকেট কাটা যাবে। কিছু টিকেট গতরাত থেকেই বিক্রি শুরু হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক সাল্হা উদ্দিন জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে কক্সবাজার চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর রাজশাহী, যশোর ও বরিশালে প্রতিদিনই চলবে ফ্লাইট। এর মধ্যে একমাত্র সৈয়দপুরে চলবে তিনটে করে ফ্লাইট। বাকি সবগুলোতে দুটো করে।
লঞ্চ : দুপুরে সদরঘাট গিয়ে দেখা যায়-দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের প্রতিটি লঞ্চ কোম্পানিই নিজেদের আসন বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানেও সিট খালি রেখেই চালাতে হবে লঞ্চ। এজন্য আলাদা কয়েকটি লঞ্চের সিটে দাগ দেয়া হয়েছে। আজ বুধবার রাত থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু হবে ঢাকা বরিশাল চাদপুর ও খুলনার লঞ্চ।
উলেখ্য, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৪ জুন জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শে সারাদেশে ১৪ দিনের ‘শাটডাউনে’র সুপারিশ করা হয়। কমিটির সুপারিশের আলোকে ২৮ জুন থেকে ৩০ জুন তিন দিন সীমিত পরিসরে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর ১ জুলাই থেকে দেশব্যাপী শুরু হয় কঠোর বিধিনিষেধ। এর আওতায় বন্ধ করা হয় গণপরিবহন চলাচল।