কঠোর বিধিনিষেধেও কোন কাজ হচ্ছে না, মানুষ বেপরোয়া

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
একদিনে দুই শতাধিক মৃত্যুর পরও হুশ হয়নি মানুষের। কারণে-অকারণে সড়কে অবাধ বিচরণ চলছেই। গত বুধবার এক হাজার এমন পথচারীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাতেও টনক নড়েনি। রাস্তায় বের না হলে যেন তাদের পেটের ভাতই হজম হয় না। প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করলেও ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা চালু রয়েছে। এ সুযোগেই একদিকে কর্মজীবী মানুষগুলোকে প্রতিদিন অফিসে ছুটতে হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের দেখাদেখি অন্যরাও তুচ্ছ অজুহাতে বের হচ্ছে। কঠোর বিধিনিষেধের অষ্টম দিন বৃহস্পতিবার গোটা রাজধানীতেই ছিল যানজট। এরই মাঝে আরও একধাপ এগিয়ে যাত্রাবাড়ীতে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে পোশাককর্মীরা বেতন ভাতাদির দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। তাদের ক’জনের প্রশ্ন ‘কিসের করোনা- কিসের মৃত্যু- বেতন ভাতাই আসল। আগে পেট- তারপর আইন’। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে বেতন ও বোনাসের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন এপেক্স এ্যান্ড সিনহা গ্রুপের শ্রমিকরা। এতে দুই মহাসড়কেই ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট তৈরি হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে এ শুরু হয় এই অবরোধ। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অবরোধ চলছে। হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, পোশাক শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তায় অবরোধ শুরু করলে যানজট তৈরি হয়। আমরা চেষ্টা করছি তাদের সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ ভঙ্গের দায়ে চার হাজারের বেশি গ্রেফতার হয়েছে। তাদের আশি ভাগই নিম্ন ও গরিব শ্রেণীর। ঢাকার একটি আদালতে আছিয়া নামের এক মা তার ছেলের জামিন করাতে এসে চিৎকার করে বলেছে, লকডাউন শুধু গরিবের বেলায়। একটু খাবার কিনতে গিয়ে ছেলেটা আমার ঘরের বাইরে যাওয়ায় পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এখন আদালতে আমাকে আসতে হয়েছে জামিনের জন্য। এক বাটপার টাকা চায় দেড় হাজার। কি করব?
কঠোর বিধিনিষেধের অষ্টম দিনে যাত্রাবাড়ী এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চেকপোস্টগুলোতে শিথিলতা দেখা গেছে। বিধিনিষেধের প্রথম দিনগুলোতে যে চেক পোস্টগুলোতে প্রায় প্রতিটি গাড়িকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হচ্ছিল- বৃহস্পতিবার সেখানে গা-ছাড়া ভাব দেখা গেছে। কিছু কিছু চেকপোস্ট অনেকটাই খালি পড়ে আছে। ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা কিংবা কনস্টেবলদের আশপাশে বসে গল্প করতে দেখা গেছে। এসব চেকপোস্ট দিয়ে অবাধে গাড়ি চলাচল করছে। এই মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। মানুষের চলাচলও বেড়েছে। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়া চেকপোস্টে কিছুটা কড়াকড়ি দেখা গেছে। রায়েরবাগে ঢাকায় প্রবেশ ও ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে বিধিনিষেধের প্রথমদিন থেকেই চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। শুরুর দিনগুলোতে এই চেকপোস্টে কড়াকড়ি ছিল। বৃহস্পতিবার দুটি পোস্টে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা গেছে, কোন গাড়িকে পুলিশের চেকের মুখে পড়তে হচ্ছে না। অবাধে গাড়ি চলাচল করছে। এ মহাসড়ক দিয়ে প্রচুর প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও রিক্সা চলতে দেখা গেছে। কিছু কিছু সিএনজিচালিত অটোরিক্সাও চলতে দেখা গেছে।
দুপুরে এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখা যায় বিপুলসংখ্যক যানবাহনের জট। এক গাড়িচালক জানান, অফিস যাতায়াতের জন্য কোন কোন প্রতিষ্ঠান নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে। ভাড়া করা বড় বাসও রয়েছে এ তালিকায়। যাদের অফিসের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা নেই তারা কেউ রিক্সা, কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ হেঁটে অফিসে যাতায়াত করছেন। অবশ্য বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি। অনেকটা অবাধেই চলছে এসব ব্যক্তিগত গাড়ি। এর সঙ্গে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলেও যাত্রী নিয়ে অবাধে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। যেসব এলাকায় বিশেষ অভিযান চলছে না, সেখানে এসব ব্যক্তিগত গাড়ি, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চলাচলে কোন ধরনের বাধা পেতে দেখা যায়নি। এদিন সকাল থেকেই উত্তরা এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি, রিক্সা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পরিবহন অনেকটা নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। নেই শুধু গণপরিবহনের উপস্থিতি। এছাড়া মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। পুলিশ চেকপোস্টগুলোতে তল্লাশি কার্যক্রম চলছে ঢিলেঢালাভাবে। তবে যেসব চেকপোস্টে গাড়ি থামানো হচ্ছে, সেসব জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এসব দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ চলছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসডকের উত্তরা এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া অন্যান্য এলাকাতেও সরেজমিনে দেখা যায়- গত কয়েকদিনের তুলনায় সড়কে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে। অবাধে চলছে ব্যক্তিগত গাড়ি, রিক্সা, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অফিসের বড় বাসও চলাচল করছে। অনেকে রিক্সায় চড়ে নিজ গন্তব্যে ছুটছেন। কেউ কেউ চলাচল করছেন হেঁটেই। এছাড়া বিভিন্ন মোড়ে অসংখ্য মানুষকে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। মূল সডকের পাশেই শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথে কর্মরত জালাল জানান, গত দুই-তিন দিন ধরেই রাস্তায় প্রাইভেটকার, রিক্সা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে। রাস্তায় মানুষের উপস্থিতিও অনেক বেশি। শুরুতে সড়কে রিক্সা এত বেশি দেখা যায়নি। আগে ব্যক্তিগত গাড়ি চেক করা হলেও এত গাড়ি দেখা যায়নি।
বিধিনিষেধের শুরুতে উত্তরা পূর্ব থানার সামনের চেকপোস্টে কঠোরতা দেখা গেছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সেখানে ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। সড়কে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ। চেকপোস্টে গাড়ি থামালেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া দায়িত্বরতরা একদিকে গাড়ি চেক করতে গেলে অন্যদিক দিয়ে দুই-চারটি গাড়িকে দ্রুত বেগে চলে যেতে দেখা গেল। সেখানে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানান, সবাই উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়ে যাচ্ছেন। সবাই সরকারী নিয়মের মধ্যে পড়েই যাচ্ছেন টঙ্গী থেকে রিক্সায় উত্তরার রাজলক্ষ্মী এলাকায় এসেছেন তাজউদ্দিন আহমেদ নামের একজন। তিনি বলেন, রিক্সায় এসেছি। খুব বেশি সমস্যা হয়নি। ব্যাংকে কাজ আছে, আসতে হলো। না এসে উপায়ও নেই।
বিকালে রামপুরা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কয়েকটি বড় বাস যাত্রী নিয়ে ছুটে চলছে। এ বাসগুলো কোন না কোন কোম্পানির ভাড়া করা। বড় বাসের পাশাপাশি প্রচুর ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে। এমনকি ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলও যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। রামপুরা থেকে মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, কাকরাইল, পল্টন, মতিঝিল এলাকায়ও একই দৃশ্য দেখা গেছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গাড়ির চাপ কম থাকলেও এসব অঞ্চলে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারীদের বেশ তৎপর দেখা যায়। তবে কোন গাড়িতে তল্লাশি করার দৃশ্য দেখা যায়নি। গাড়ি সিগন্যালে থামা অথবা চলাচলের নির্দেশনা দিতে দেখা যায় ট্রাফিক সিগন্যালে দায়িত্ব পালনকারীদের। মতিঝিলের একটি অফিসে চাকরি করেন সাইদুর রহমান। রামপুরার বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হওয়া সাইদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় মালিবাগ আবুল হোটেল সিগন্যালে। তিনি বলেন, লকডাউনের শুরু থেকেই আমাদের অফিস খোলা। প্রতিদিন অফিসে যেতে হয়। এখনও পর্যন্ত যাতায়াতের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয়নি। আজও রাস্তায় কোন সমস্যা দেখছি না। কোন প্রকার তল্লাশি ছাড়ায় চলাচল করতে পারছি। কাকরাইল মোড়ে কথা হয় একটি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের আওতায় মোটরসাইকেল চালানো আরিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, পার্সেল ও যাত্রী আনা নেয়ার জন্য আমাদের সেবা চালু রয়েছে। যেখানে বিশেষ অভিযান চলে, সেখানে যাত্রী নিয়ে যেত সমস্যা হয়। তাছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে কোন সমস্যা হয় না। যাত্রীর মাথায় হেলমেট থাকলে ট্রাফিক পুলিশ কোন বাধা দেয় না, আমার পরিবার আছে। আয়ের বিকল্প কোন উৎস নেই। ফলে বাধ্য হয়েই এই করোনার মধ্যেও মোটরসাইকেলে ভাড়া মারছি। আল্লাহর রহমতে এখনও কোন সমস্যার মধ্যে পড়িনি।
উল্লেখ্য, কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে ২১টি শর্ত দেয়া হয়।