বাঙালি সমাজে পারিবারিক মূল্যবোধ এক সময়ে ছিল অসাধারণ। নবজাতকের জন্মের আগে এবং পরে পরিবারের নতুন সদস্য বা অতিথিকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন আনন্দের ঢল নামত। আর সেটির প্রকাশও হতো বিচিত্র, বর্ণাঢ্য ও সুখকর। সচরাচর শিশুর দাদাবাড়িটিই হতো প্রধান ঠিকানা। কিন্তু তার নানাবাড়িও ছিল না অপ্রধান ঠিকানা। এই দুই পরিবার মিলে বিবিধ সম্পর্কের সুতায় ছিল ছন্দময় মধুর বন্ধন। কথা বলতে শেখার আগেই শিশুর কান পড়ে ফেলত চাচা-চাচি, ফুপু-ফুপা, মামা-মামি, খালা-খালু, আপা-ভাইসহ কত মায়ামাখা সম্বোধন। দাদা-দাদি, নানা-নানি তো সবার আগেই শিশুটির কানে বাজত মধুময় সঙ্গীত হয়ে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী বাড়িটির লোকরাও রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত না হয়েও বাঁধা পড়ত আত্মিক বন্ধনে। শিশুটি যখন একটু বড় হয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করত তখন খুলে যেত পৃথিবীতে প্রবেশের বড় একটি দরজা। তাতে থাকত আনন্দময় শিক্ষণের খোলা জানালা। সেখানেও কত আপনজন, মায়াকাড়া কত সম্বোধন ও সম্পর্ক।
কালে কালে সমাজে মূল্যবোধ বদলে যেতে শুরু করে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে হলো একক পরিবার। কর্মসূত্রে সেই এক পরিবারই আবার হয়ে উঠল বিচ্ছিন্ন পরিবার। বিশেষ করে মহানগরীর নিজস্ব নির্মোহ নিয়মে ও নাগরিক সংস্কৃতির কিছুটা কৃত্রিমতা মেশা সমাজে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই হয়ে উঠল যেন একেকটি একক পরিবার। নিজ বাসার দেয়ালের ওপারের ঘরটির বাসিন্দার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠল না। বহুতল ভবনগুলোর একেকটি পরিবার স্বয়ংসম্পূর্ণ একেকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নাগরিক সংস্করণ। এমন পরিবারে বাবা-মা ছাড়া আর কাউকেই (যদি সে হয় একমাত্র সন্তান) পেল না। সূচনায় কথিত সেই মায়ার বন্ধনযুক্ত বর্ণাঢ্য পৃথিবী তথা বৃহত্তর পারিবারিক পরিসরের সুখ ও নির্ভরতা এক নিমেষে মুছে গেল নতুন শিশুর জগত থেকে। বাস্তবতা হলো পরিবারের প্রধান হিসেবে বাবা সকালেই চলে যান কর্মস্থলে, দিনশেষে তিনি ফেরেন। অনেক পরিবারে মাও কর্মজীবী। তিনিও দিনের বেশিরভাগ সময়েই থাকেন ঘরের বাইরে। যে পরিবারে মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী, সে পরিবারের শিশু তার জগতের সবচেয়ে কাছের দুজনকেই খ-িতভাবে পায়। আর মা যদি কর্মজীবী না হন তাহলে পিতার অনুপস্থিতি শিশুটির ভেতর গড়ে দেয় শূন্যতার বোধ।
শিশুর অর্থপূর্ণ ভবিষ্যত নির্মাণ, অর্থাৎ তার সুস্থতা নিশ্চিত, মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য আমাদের অবশ্যই উপায় অনুসন্ধান করতে হবে। মনোবিদরা অবশ্যই পথ বাতলাবেন। অভিভাবকবৃন্দ ভাববেন গভীর ও যুক্তিনিষ্ঠভাবে। সৎ উপার্জন ও জীবনযাপনে ব্রতী হতে হবে। আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে অর্থাৎ শিশুর নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে অনিয়মিতভাবে হলেও দেখা সাক্ষাত ও একত্রে বসবাসের সাময়িক সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। শিশুর বিদ্যালয়ের বন্ধু বা সহপাঠীদের পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি ও চর্চা এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে শিশুর সামনে ও মনোজগতে এমন একটি আবহ তৈরি করা চাই, যাতে শিশু আর নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাববে না।