কাজিরবাজার ডেস্ক :
তরুণদের অপরাধ জগতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য অনলাইন গেম সিরিয়াল। ক্রাইম প্যাট্রোল, পাবাজি, ফ্রি-ফায়ারসহ আরও অসংখ্য অনলাইন গেম আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতের দিকে। আসক্তি থেকে মনের অজান্তেই সহিংস হয়ে উঠছে তারা। হত্যা, আত্মহত্যা, সামান্য কারণে সহিংস হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনছে পরিবারের। এ ধরনের অনলাইন সিরিয়াল গেমের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেও ফল হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এই সর্বনাশা গেম।
পুলিশের ভাষ্য, রাজধানী ঢাকার কদমতলীতে মা-বাবা, বোন-তিনজনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছে নিজেরই ঔরসজাত মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুন। প্রায় ছয় মাস আগে থেকে হত্যাকাণ্ডের কৌশল, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন সবকিছুই রপ্ত করতে ভারতীয় সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোল দেখা শুরু করেন তিনি। পরিবারের সদস্যদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকে নিজের মা-বাবা ও বোনকে হত্যা করার বিষয়ে মেহজাবিন ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। মেহজাবিন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি ছয় মাস আগে থেকে পরিবারের সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং একাধিক ব্যক্তিকে একা হত্যা করার কৌশল শিখতে ভারতের সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোল দেখা শুরু করেন। প্রথমে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে মেহজাবিন তার মা-বাবা, বোনসহ পাঁচজনকে অচেতন করেন। এরপর হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে তিনজনকে খুন করে নিজেই ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশকে জানান। দুই মাস আগেও একবার তরমুজের জুসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পরিবারের সদস্যদের হত্যার চেষ্টা করেন মেহজাবিন-জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দিয়েছেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতবছর অক্টোবরে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকার আলোচিত জোড়া খুনের ঘটনায় গ্রেফতার ফারুক জানান, ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোল দেখে মা-ছেলেকে খুনের পরিকল্পনা করেন তিনি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক জানান, গুলনাহার নামের এক নারীকে তিনি বোন ডেকে নিয়মিত তার বাসায় যেতেন। কিন্তু ব্যবসা নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় ক্রাইম প্যাট্রোল দেখে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন।
গতবছর নবেম্বরে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় রাহানূর নামের এক ব্যক্তি ক্রাইম প্যাট্রোল দেখে নিজ ভাই, ভাবিসহ পুরো পরিবারকে হত্যা করেন। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে রাহানূর বলেছেন, কোমল পানীয়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে চাপাতি দিয়ে তাদের হত্যা করার কথা জানিয়েছেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জে আখিরুল ইসলাম নামে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ফ্রি-ফায়ার গেম খেলার জন্য তার কৃষক বাবাকে স্মার্টফোন কিনে দিতে বলে। আর তা না দেয়ায় আখিরুল চলতি বছরের মে মাসে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে। নিহতের ভাই রবিউল ইসলাম বলেন, তার ছোট ভাই মোবাইল ফোনে ফ্রি-ফায়ার গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। বন্ধুদের দেখাদেখি আখিরুলও নিজের মোবাইলে এই গেম খেলতে মোবাইল কিনে দেয়ার আবদার করে। তবে ফোন কিনে দেয়ার আশ্বাস দিলেও ধৈর্য ধরতে পারেনি আখিরুল। অভিমানে আত্মহত্যা করে।
চলতি জুনেই ফ্রি-ফায়ার, পাবজি গেমকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের পাঁচশত বিঘা গ্রামের স্কুলছাত্র আশিক রহমান আত্মহত্যা করে। আশিকের মা খাদিজা আক্তার বলেন, গেমের প্রতি তীব্র আসক্তির কারণে ছেলের অকাল মৃত্যু হয়।
চলতি জুন মাসের গত সপ্তাহে রাজধানী ঢাকার কদমতলীতে নিজের ঔরসজাত সন্তান মেহজাবিন ইসলাম মুন তার মা-বাবা ও বোনকে হত্যা করতে ভারতীয় ক্রাইম প্যাট্রোল দেখার বিষয়ে জানানোর পর অনলাইন গেমসহ এই ধরনের ভারতীয় সিরিয়াল দেখার বিষয়টি তদন্তর সামনে এসেছে।
সাইবার ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, তিন বছর আগে ২০১৮ সালে প্রাণঘাতী ব্লু-হোয়েল খেলে কয়েকজন শিশু-কিশোর আত্মহত্যা করে। সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ইউনিট এই ধরনের খেলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তিন বছর আগের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনলাইন গেম, মুঠোফোন ও ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়ানোর ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। শুধু ভারতীয় সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোল দেখেই দেশে গত কয়েকবছরে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। শুধু ভারতীয় সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোল দেখেই দেশে গত কয়েকবছরে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আবার ভারতীয় সিনেমা দেখে ফিল্মিস্টাইলে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। কিশোররা অনলাইন গেম, মুঠোফোন ও ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। আবার ভারতীয় সিনেমা দেখে ফিল্মিস্টাইলে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। ভারতীয় অপরাধবিষয়ক সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোল, অনলাইন গেম পাবজি, ফ্রি-ফায়ার দেখে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর। অপরাধবিষয়ক এসব সিরিয়াল দিনের পরদিন দেখে ঠাণ্ডা মাথায় কাছের মানুষকে খুন করার মতো রোমহর্ষক ছক আঁটছে কেউ। আবার বিভিন্ন সহিংস অনলাইন ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে শিশু-কিশোররা একদিকে যেমন সহিংস হয়ে উঠছে অন্যদিকে অভিমানের বশে অনেকেই করছে আত্মহত্যা। এ্যাকশনধর্মী ভারতীয় সিনেমা, সিরিয়াল ও ভিডিও গেমের প্রভাবে মনের অজান্তেই তারা ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে ওঠার বিষয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, সব মানুষ এ ধরনের অপরাধ করে না। যাদের ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তারাই করে। অথবা যারা ‘প্যারানোয়েড সাইকোসিস’, ‘ডিলুইশনাল ডিজঅর্ডার’-এ আক্রান্ত তারা সিরিয়াল দেখে মানুষকে হত্যাকাণ্ডের মতো ছক তৈরি করে। এক্ষেত্রে অপরাধীরা যে অপরাধ করছে তা ‘কপিক্যাট ক্রাইম’। অর্থাৎ অপরাধী আগের কোন অপরাধ কর্মকাণ্ড দেখে একইভাবে সেই অপরাধ পুনরায় ঘটায়। বাংলাদেশে সিরিয়াল দেখে অপরাধ করার ঘটনা অনেক আগে থেকে হচ্ছে না, এটা বিগত কয়েকবছর ধরে শুরু হয়েছে বলা চলে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সিরিয়াল দেখে মানুষের অপরাধ করার ঘটনা অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে। যারা সিরিয়াল দেখে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটায় তারা মনের ক্ষোভ মেটাতেই এ ধরনের কাজ করে। এক্ষেত্রে অপরাধী নিজের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ‘চ্যানেলাইজড’ করে। এ ধরনের সিরিয়ালগুলো হত্যাকারীদের হোমোসাইডাল পটের খোরাক জোগায় বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন খন্দকার ফারজানা রহমান বলেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, টিভির বিভিন্ন সিরিয়াল এই অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটানোর জন্য অপরাধীকে অনুপ্রাণিত করে। যেহেতু মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এখন মিডিয়ার প্রভাব অনেক বেশি, এখন মানুষ তাই বাস্তব জীবনের চেয়ে ভার্চুয়াল জীবনে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একটি চলচ্চিত্র দেখে অনেকে সেই ঘোর থেকে বের হতে পারে না। আবার শিশু-কিশোররা ভিডিও গেম খেলে অনেক বেশি সহিংস আচরণ করছে। এই হিসেবে ক্রাইম প্যাট্রোল দেখে অপরাধীদের অনেকেই অপরাধে উৎসাহী হচ্ছে। আগে পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটালেও এখন মানুষ মোবাইল, টিভি কোন না কোন যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত। এতে মানুষ নিজের আলাদা পৃথিবী তৈরি করে নেয়। এখন পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশ্বাসপূর্ণ সম্পর্ক আর নেই। এতে মানুষের মায়া, মমতা ও ভালবাসার মতো অনুভূতিগুলোর জায়গা ক্ষোভ, লালসার মতো নেতিবাচক অনুভূতিগুলো দখল করে নিচ্ছে। এতে ভার্চুয়াল মিডিয়ার নেতিবাচক অনুভূতিগুলো মানুষ ধারণ করে আপনজনকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার পরিকল্পনা করছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেছেন, যেহেতু এ ধরনের সিরিয়ালের মাধ্যমে কোন বিনোদন হচ্ছে না এ জন্য এসব প্রচারে চ্যানেল বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের আরও সতর্ক হতে হবে। যারা অপরাধ কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয় তাদের জন্য এগুলো চিন্তার খোরাক জোগায়। এ ধরনের সিরিয়ালগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত। অভিভাবকদের নিজ সন্তানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তারা এসব সিরিয়াল বা ক্ষতিকর গেমে আকৃষ্ট কি না দেখতে হবে। যদি হয়, তখন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আবার যখন কোন মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বোধ তৈরি হয় তখন তার মধ্যে সিরিয়াল সুইসাইড করার মানসিকতা কাজ করে। তবে কোন মানসিক রোগী যদি তার চিকিৎসকের কাছে এ ধরনের অপরাধ সে ভবিষ্যতে ঘটাতে পারে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে, তাহলে সেই চিকিৎসককে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত বিষয়টি জানাতে হবে। কিন্তু দেশের মানুষ এই সিরিয়ালগুলোর নেতিবাচক বিষয় নিয়ে সচেতন না হওয়ায় তা টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে। আর এসব কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।