কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুধু বাবাদের জন্য আলাদা করে একটি দিন। বিশ্ব বাবা দিবস। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার দিবসটি উদযাপন করা হয়। আজ ২০ জুন সেই বিশেষ দিন। গভীর আবেগ উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসায় পূর্ণ বাবা দিবস। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি উদযাপন করা হবে। বাবা থাকবেন কেন্দ্রে। তাকে ঘিরে আনন্দ উৎসবে মাতবে সন্তানরা। এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে!
সন্তানের কাছে, বলার অপেক্ষা রাখে না, বাবাই সব। সব কিছুর ঊর্ধ্বে তার স্থান। এক জীবনে কত রকমের নায়ক বা হিরো কল্পনা করি আমরা। কিন্তু সুপার হিরোটি সব সময়ই বাবা। ফেসবুক ইনস্টাগ্রামের যুগে ‘ফ্যান’ ‘ফলোয়ার’ সংখ্যা নিয়ে কত না হৈ চৈ। তবে বাবার ‘ফ্যান’ ‘ফলোয়ার’ সবচেয়ে বেশি। তার চেয়ে ব্যক্তিত্ববান তার চেয়ে সুপুরুষ আর হয় না। তার মতো করে চুল আঁচড়ানো। তার মতো জুতো জামা পরে সকাল সকাল অফিস যাওয়ার জন্য বায়না ধরা। শৈশবের এমন আরও কত শত স্মৃতি নিয়ে বড় হয় সন্তান! অভিন্ন অনুভূতির কথা জানিয়ে হুমায়ূন আহমদ লিখেছিলেন, পৃথিবীতে খারাপ মানুষ অনেক হয়। খারাপ বাবা একটিও হয় না। হ্যাঁ, বাবা তার সন্তানের কাছে শুধু ভাল নয়, ভালর অধিক।
সাদামাটা চোখে দেখলে বাবা কঠিন। মেজাজি। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে, না, এমন নয়। ক্ষেত্রবিশেষে গুরুগম্ভীর। রাশভারি স্বভাবের। মা সন্তানের কাছে যতটা সহজ, যত কাছের, বাবা আপাত দৃষ্টিতে ততটা নন। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ঢোকা বাবার শরীর থাকে ক্লান্ত। চোয়াল শক্ত হয়ে থাকে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হয় মেপে। সামান্য ভুলচুক হলেই বকা খাওয়ার ভয়। তবে চারপাশে দেয়াল তুলে রাখা এই বাবাকে কোন না কোনদিন ঠিক চিনে ফেলে সন্তান। তখন পিতার পদযুগলের কাছে মাথানত হয়ে আসে। জলে ভিজে যায় চোখ। পাশাপাশি আজকের বাবাদের অনেকেই সন্তানের বন্ধুটি হয়ে যান। এই বন্ধুতার কোন তুলনা হয় না।
মূলত এসব কারণেই আলাদা তাৎপর্যের হয়ে ওঠে বাবা দিবস। এক সময় দিবসটির কথা অনেকে জানতেন না। এখন আগেভাগেই উদ্যাপন শুরু হয়ে যায়। আজও তা-ই হবে। প্রিয় পিতার হাতে সন্তানরা আজ ফুল তুলে দেবে। দারুণ কোন উপহার দিয়ে চমকে দেয়ার চেষ্টা করবে। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে কেক কাটা হবে। কেউ মুখ ফুটে বলবে, ‘ভালবাসি, বাবা।’ কেউ বলবে মনে মনে। আর এই কোভিডকালে যারা পিতাকে হারিয়েছেন, তাদের তো দুঃখের সীমা নেই। হয়ত ভেজা চোখেই কাটাবে গোটা দিন।
অবশ্য দিবসটির আবেগ উদযাপন বেশি দৃশ্যমান হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বাবা হয়ত আজ জানবেনও না, ফেসবুকে টুইটারে সন্তান কত আবেগী ভাষায় তার কথা লিখেছে, কত আদরে ভালবাসায় স্মরণ করছে তাকে। আর যারা নিজেরাও বাবা হয়েছেন তারা ফিরে যাবেন শৈশবে। পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বাবাকে আবিষ্কারের চেষ্টা করবেন। বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়…। এই দেখা আর হবে না। নিজের শিশু সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে কষ্ট ভোলার চেষ্টা করবেন তারা।
বাবা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাওয়া। সন্তানের আবদার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে মায়ের কাছে। এটা চাই। ওটা দাও। মা এই আবেদন নিবেদন সময় সুযোগ মতো বাবার কাছে পৌঁছে দেন। দিন-রাত পরিশ্রম। খাটুনি। কিন্তু নিজের জন্য নয়। সন্তানের ভবিষ্যত গড়ে দেয়াই লক্ষ্য। বাবা নিজে ভালো খেয়ে বা নতুন জামা গায়ে দিয়ে সুখী হন না। সন্তানের খুশিতেই তার খুশি।
বাবাদের ভেঙ্গে পড়তে নেই। কাঁদতে মানা। কারণ বাবা কাঁদলে বাবা ভেঙ্গে পড়লে সন্তানদের আর আশা থাকে না। কবির ভাষায় : ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো,/ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!’ কবি আবুল হাসানের সেই ঝিনুকই যেন বাবা। সব কষ্ট একা বুকে বয়ে বেড়ান। সন্তানকে বুঝতে দেন না।
বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’র কথাই যদি বলি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবিতে আমরা খুঁজে পাই অসাধারণ এক বাবাকে। জার্মান সেনারা শিশুপুত্রসহ পিতাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে বাবার ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছেলেকে এতটুকু আঁচ করতে দেন না তিনি। বরং ছেলের খুশি ধরে রাখতে উল্টো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এখানে একটি খেলা চলছে। যে বেশি পয়েন্ট পাবে তাকে সত্যিকারের একটি ট্যাঙ্ক উপহার দেয়া হবে। বাবা ছেলেকে বোঝান, সে যদি বারবার মায়ের কাছে যাওয়ার জেদ ধরে, খিদে পেলে খাওয়ার জন্য কান্না করে, আর ঘরে লক্ষ্মী ছেলের মতো লুকিয়ে না থাকে তাহলে পয়েন্ট কাটা যাবে। শিশুপুত্র পয়েন্ট হারাতে চায় না। সে বাবার সব কথা মেনে চলে। অথচ বাবা জানেন, জার্মান সেনারা তাকে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে। হত্যার শিকার হন বাবা। কিন্তু কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আতঙ্ক একদমই ছুঁতে পারে না সন্তানকে। এই হলো বাবা।
স্নেহবৎসল পিতা সম্রাট বাবরের কথাও কারও অজানা নয়। এ-ও আরেক ইতিহাস। পুত্র হুমায়ুন অসুস্থ। কোন চিকিৎসাতেই কাজ হচ্ছে না। জীবনের শঙ্কা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কিংবদন্তি আছে, এ অবস্থায় অসহায় পিতা সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এর কিছুদিন পরই হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। আর সম্রাট বাবর অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলেন। অচিরেই মৃত্যু হলো তার। কবির ভাষায় : মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনও ক্ষয়,/পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়…। আজও পৃথিবীর অসংখ্য বাবা সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। তাদের ঋণ কোন সন্তানের পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। তবুও ফাদার্স ডে-তে জন্মদাতা পিতার প্রতি সন্তানেরা তাদের বুকে জমানো ভালবাসা উজার করে দেয়। বাবারাও আপ্লুত হন। আজও হবেন।
প্রসঙ্গত, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় সর্বপ্রথম বাবা দিবস উদ্যাপিত হয়। পাশাপাশি সনোরা স্মার্ট ডড নামের ওয়াশিংটনের এক ভদ্র মহিলার মাথাতেও বাবা দিবসের চিন্তা আসে। ১৯০৯ সালে ভার্জিনিয়ার বাবা দিবসের কথা তিনি জানতেন না। ডড এই ধারণা পান গির্জার এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে। সেই পুরোহিত মাকে নিয়ে অনেক ভালো ভাল কথা বলছিলেন। তখনই তার মনে হয়, বাবাদের নিয়েও কিছু করা দরকার। পরে তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই পরের বছর ১৯১০ সালের ১৯ জুন থেকে বাবা দিবস উদ্যাপন শুরু করেন। কালক্রমে এসেছে বাংলাদেশেও। বর্তমানে এ দেশেও দিবসটি ভীষণ জনপ্রিয়।