মহানবী (সা.) এর দর্শনে মানবাধিকার

20

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

মহানবী (সা.) এর আবির্ভাব ঘটে আরব দেশে এক বেদুঈন অঞ্চলে, যেখানে অতীতে কখনো নগর জীবনের নান্দনিকতা ও সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। এখানকার জাহিলী পরিবেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত সমাজে জাহিলিয়্যাত ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। মহানবীর (সা.) আগমনের সমসাময়িককালে মক্কার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবাহ, শায়বাহ প্রমুখের হাতে। মানবাধিকার সম্পর্কে তাদের স্বচ্ছ ধারণা ছিল না বলে প্রতিনিয়ত তাদের হাতে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত ও পর্যুদস্ত হচ্ছিল। এমনি এক বৈরী পরিবেশে আবির্ভূত হওয়ার পর মহানবী (সা.) লক্ষ্য করেন যে, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু সন্তান পিতৃহারা হয়, অগণিত নারী হয় স্বামী কিংবা পুত্রহারা। মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হয় এই যুদ্ধ-বিগ্রহে। অসহায়-দুস্থ-দুর্গত লোকজন বঞ্চিত হয় তাদের প্রাপ্য অধিকার হতে, ইয়াতীম-নি:স্ব বিধবাও বঞ্চিত হয় তাদের ন্যায্য পাওনা হতে। অত্যাচারীদের দোর্দ- প্রতাপ দুর্বল অসহায় লোকদের সদা সন্ত্রস্ত করে রাখে। সুতরাং এই বিপর্যয়কর অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য মাত্র ১৭ বছর বয়সে মহানবী (সা.) মানবাধিকারের কতিপয় ধারা সংযোজনপূর্বক ‘হিলফুল ফুযূল’ গঠন করেন, যার মূল বক্তব্য ছিল- সমাজ হতে অশান্তি দূর করা, পথিকদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অভাবগ্রস্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, মজলুমের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং কোন অত্যাচারীকে মক্কায় আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়া।
হিজরতের অব্যবহিত পূর্বে মহানবী (সা.) হজ্ব উপলক্ষে ইয়াছরিব হতে মক্কায় আগত খাযরাজ গোত্রীয় লোকদেরকে আল-আকাবা নামক স্থানে যে বায়আত বা আনুগত্যের শপথ করান তাতে মানবাধিকারের মৌলিক কতিপয় ধারা লক্ষ্য করা যায়। মহানবী (সা.) বলেনÑ “তোমরা আমার হাতে এ বিষয়ে আনুগত্যের শপথ (বায়আত) কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, যেনা-ব্যভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কারো বিরুদ্ধে মনগড়া কোন মিথ্যা অপবাদ দিবে না”। মহানবী (সা.) এর উক্ত বাণীতে ধর্ম পালনের অধিকার, সম্পদের অধিকার মান-মর্যাদাও সম্ভ্রমের অধিকার এবং জীবনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
৬২২ খ্রি. মহানবী (সা.) যখন মক্কা হতে ইয়াছরিব তথা মদীনায় হিজরত করেন তখন মদীনায় তিন শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বাস করতোÑ এক: একনিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় দুই : মদীনার আদি মুশরিক তথা পৌত্তলিক সম্প্রদায় এবং তিন : মদীনার ইয়াহুদী সম্প্রদায়।
এ ধরণের একটি বহু জাতিক ও বহুধর্ম ভিত্তিক অঞ্চলে হিজরত করে মদীনার ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রধান হিসাবে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে মহানবী (সা.) হিজরতের প্রথম বর্ষে একটি লিখিত সনদ জারী করেন। ইতিহাসে এটি ‘মদীনা সনদ’ নামে প্রসিদ্ধ। আরবী ভাষায় জারীকৃত এই সনদে ৫৩টি ধারা বিদ্যমান ছিল, যার অনেকগুলো ধারাই ছিল মানবাধিকার বিষয়ক। এতে উল্লেখ করা হয় যে, মদীনায় বসবাসকারী সকল ইয়াহুদী এবং ইয়াছরিব ও কুরাইশের সকল মুসলিম জনগোষ্ঠী একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং সকলে সমান নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ভোগ করবে। পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে এবং কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যাবে না, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে প্রচলিত প্রথা ও ন্যায়বিচার মোতাবেক রক্তপণ আদায় করতে হবে, কেউ বন্দী হলে ন্যায়বিচার মোতাবেক তাকে মুক্ত করতে হবে, দুর্বল ও অসহায়কে আশ্রয় দেয়া হবে এবং সর্বতোভাবে তাদের রক্ষা করা হবে, ঋণগ্রস্তদের ঋণের বোঝা লাঘব করা হবে, অত্যাচারী, পাপিষ্ঠ এবং সমাজে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সকলে অবস্থান গ্রহণ করবে, তারা কারো সন্তান কিংবা নিকটাত্মীয় হলেও। কোন অন্যায়কারীকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে না এবং কোন প্রকার আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। কেউ কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, মহানবী (সা.) এর পূর্বানুমতি গ্রহণ ব্যতীত কেউ যুদ্ধে জড়িত হতে পারবে না, একজনের অপকর্মের জন্য অন্যজনকে দায়ী করা যাবে না, ইয়াহুদীদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে, বহি:শত্রু দ্বারা মদীনা আক্রান্ত হলে একে রক্ষা করার জন্য সকলে সম্মিলিত প্রায়াস চালাবে। এভাবে মদীনা সনদের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও গোত্রের মানুষের পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা বিধানের নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই প্রথম। সমাজের সকল শ্রেণীর নাগরিকের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম ও ধর্মীয় অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান এবং পরমত সহিষ্ণুতা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের পারস্পরিক সমঝোতা ও সম্প্রীতির উপর ভিত্তি করে রচিত মদীনা সনদ বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান বা শাসনতান্ত্রিক সরকারের মর্যাদা লাভ করে।
বিদায় হজ্বে প্রদত্ত মহানবী (সা.) এর ঐতিহাসিক ভাষণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত। কোন আন্দোলন কিংবা সংগ্রামের মুখে নয়, কোন চাপের কাছে নত স্বীকার করে নেয়, সম্পূর্ণ নবুওয়তী দায়িত্ব ও কর্তব্যের খাতিরে স্বত:স্ফূর্তভাবে প্রদত্ত এই ভাষণে তিনি মানবাধিকার বিষয়ে যে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি বলেন, ‘আজকের এই দিন, এই মাস ও এই শহর তোমাদের নিকট পবিত্র অনুরূপভাবে তোমাদের জীবন এবং সম্পদ ও পবিত্র’।
রাসূল (সা.) আরো বলেন, কারো নিকট কোন সম্পদ গচ্ছিত থাকলে তা প্রকৃত মালিকের নিকট অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। জাহিলী যুগের সমস্ত সুদ প্রথা রহিত করা হল, কিন্তু মূলধন ফেরত পারবে।” “সম্মতি ও সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা অবৈধ। “জাহিলী যুগের সকল রক্তের প্রতিশোধ রহিত করা হল”। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদ-, আর অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যার শাস্তি হল একশত উট রক্তপণ আদায়। মহানবী (সা.) কর্তৃক মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি জাতিসংঘের  The Universal Declaration of Human Rights (1948)  এর ৩, ৬ ও ১৭ নং অনুচ্ছেদে এবং সংবিধানের ৩২, ৪২, ৪২ (১) নং অনুচ্ছেদেও স্থান পেয়েছে।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, “তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। আবার তোমাদের উপরও তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হল তোমাদের বিছানায় তোমরা ছাড়া অন্য কেউ যেন না যায় এবং তারা যেন কোন অশ্লীল কাজ সম্পাদনা করে; তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর নির্দেশে তোদের সাথে দাম্পত্যের সম্পর্ক স্থান করে তাদেরকে নিজেদের জন্য বৈধ করেছ। স্বামী-স্ত্রীর মানবাধিকার বিষয়টি জাতিসংঘের  The Universal Decelaration of Human Rights এর ১৬নং অনুচ্ছেদে এবং International Covenent of Civil and Political Rights (ICCPR)  এর ২৩নং অনুচ্ছেদ স্থান লাভ করে।
মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সীমারেখা নির্ধারণ করে মহানবী (সা.) বলেন “এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। আর মুসলিম জাতি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
অতএব, পারস্পরিক সম্মতি ও সন্তুষ্টি ব্যতীত কোন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা বৈধ নয়”। মহাবী (সা.) আরো বলেন, “তোমাদের রব এক এবং তোমাদের পিতা এক। সকলকে আদম থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর আদম আ-কে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। এভাবে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধকে অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে। ঋুুবব বলেন, ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা কেবল প্রচার-প্রোপাগা-ার মধ্যেই সীমিত নয়; বাস্তব জীবনেও তা অনুসরণের তাগিত দেয়া হয়। বস্তুত ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ইসলামের চিরন্তন সোনালী অধ্যায়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংগ। জাতিসংঘের The Universal Declaration of Human Rights- এর ১নং অনুচ্ছেদে মানুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বসূলভ আচরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
দাস-দাসীদের সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, “তোমরা দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান থাকবে। তারা তোমাদেরই ভাই। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খেতে দেবে, তোমরা যা পরবে, তাদেরকেই তা পরতে দেবে। তাদের ্পর কোন প্রকার নির্যাতন চালাবে না, তাদের মনে আঘাত দিবে না।” শুধু তাই নয়, মহানবী (সা.) স্বীয় দাস যায়েদকে মুক্ত করে দিয়ে নিজের প্রতিপাল্য হিসেবে গ্রহণ করে দাসদেরকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন। জাতিসংঘের  The Universal Declaration of Human Rights- এর ৪নং অনুচ্ছেদে এবং International of civil and political Rights (ICCPR) এর ৮নং অনুচ্ছেদেও দাসত্বের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বংশ কৌলিণ্য ও বর্ণবাদ বিষয়ে মহানবী (সা.) বলেন, “কোন অনারব ব্যক্তির ওপর কোন আরববাসীর এবং কোন কৃষ্ণাঙ্গের উপর কোন স্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একমাত্র মাপকাঠি হল তাকওয়া।” উক্ত বক্তব্যে মহানবী (সা.) বংশ কৌলিণ্য বর্ণবাদ প্রথাকে স্থান দেননি।
১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর The Declaration on the Elemination of all forms of Racial Discrimination এর অনুচ্ছেদ-এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য হল মানব মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ এবং তা  United Nations Charter the universal Declaration of Human Rights  এর পরিপন্থী এবং জাতিসমূহের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের পথে বাধা স্বরূপ।
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত  The Universal Declaration of Human Rights-  এর উত্তরাধিকার লালন করছে। বিশ শতকের প্রথম থেকেই মানব সভ্যতা অত্যন্ত অসহায়ভাবে দুটো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে। মানবাধিকারের ললাটে কালিমা লেপন করে এতে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ নারী-পুরুষ- শিশু বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। অতঃপর ভার্সাই চুক্তি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংস্তুপের উপর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একনায়কত্ব ও ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার প্রেক্ষাপটে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভয়াবহতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার প্রেক্ষাপটে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সৃষ্টিকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম মানবাধিকারের প্রতি বিশ্বসমাজের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়। ফলে নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রতি আন্তর্জাতিক চেতনা সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকো শহরে জাতি সংঘের সনদ প্রণয়নকালে এর স্থপতিগণ মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও মানুষের মর্যাদার প্রতি তাঁদের আস্থা ব্যক্ত করেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সভায় ৩০টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত যে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় তার ৩ থেকে ২১ পর্যন্ত অনুচ্ছেদসমূহে ১৯টি নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার স্থান পেয়েছে এবং এর ২২ থেকে ২৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদসমূহে ৬টি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। মানবাধিকারের এই সর্বজনীন ঘোষণা গৃহীত হওয়ার পর স্বাধীনতা প্রাপ্ত প্রায় সকল রাষ্ট্রের সংবিধানে উক্ত ঘোষণাপত্রে বর্ণিত মানবাধিকার সমূহ মর্যাদা সহকারে স্থান পেয়েছে। জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রসমূহের জন্য মানবাধিকারের এই সনদ অনুসরণ বাধ্যতামূলক করে নি। কিন্তু এটি অনুমোদন লাভ করার পর সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এতে স্বেচ্ছামূলক করে নি। কিন্তু এটি অনুমোদন লাভ করার পর সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এতে স্বেচ্ছামূলক স্বাক্ষর প্রদানপূর্বক নিজ নিজ দেশে তা বাস্তবায়নের আহবান জানানো হয়। কোন দেশ এই সনদ কতটুকু অনুসরণ করছে তা পর্যবেক্ষণও এ সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রদানের জন্য জাতিসংঘ একটি স্থায়ী মানবাধিকার কমিশন গঠন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই কমিশনের শাখা রয়েছে যার মাধ্যমে জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মানবাধিকার বিষয়ক যাবতীয় রিপোর্ট অবহিত হয়।
মাবনাধিকার সংরক্ষণের এক মহান উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বর্তমানে বিশ্বের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ এর মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় বলে মনে করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালী ও চীনকে ‘ভেটো’ প্রয়োগের নিরংকুশ ক্ষমতা প্রদান করে নিজেই মানবাধিকার লংঘনের নজীর স্থাপন করেছে। পৃথিবীর পরাশক্তিসমূহ বিশেষতঃ আমেরিকা ও ব্রিটেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার করুন শিকারে পরিণত করেছে। অথচ এরাই জাতিসংঘ ও মানবাধিকার কমিশন নিয়ন্ত্রণ করে। আর পুতুলসম জাতিসংঘেরও এমন কোন সংস্থা বা মেকানিজম নেই যা দেশে দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে কিংবা আইন দ্বারা তা মানতে বাধ্য করতে পারে। ফলে জাতিসংঘের ছাত্রছায়ায়, কোন কোন ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষত আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তি দুর্বল দেশসমূহে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার সনদকে পদতলে পিষ্ট করে আফগাস্তিান ও ইরাকে ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনীর নগ্ন আগ্রাসন, গণহত্যা, স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা হরণ, সিরিয়া, ইরান ও সৌদি আরবের প্রতি মার্কিন হুমকি, বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় সার্ব বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসান ও দমন-পীড়ন, আলবেনিয়ায় গণহত্যা, স্বাধীনতাকামী কাশ্মীর মিন্দানাওয়ে মুসলিম নিধন, মায়ানমারে মুসলিমদের ওপর জেল-জুলুম ও নির্যাতন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ও কোন কোন দেশে ঘন-ঘন সামরিক শাসন জারী, আমেরিকায় মুসলিম ও নিগ্রোদের প্রতি বৈরী আচরণ, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে নাগরিক অধিকার হরণ, দেশে দেশে বোমাতংক এবং সামাজিক নৈরাজ্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতি আজ জাতিসংঘের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতিকেও আজ বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। ফলে মনে হয়, গুটি কয়েক রাষ্ট্রকে ভেটো প্রয়োগ ক্ষমতা প্রদান করে জাতিসংঘ এসব রাষ্ট্রকে তার সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ হতে ফায়দা লুটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পক্ষান্তরে এই ব্যবস্থা বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা, আদর্শিক অসচেতনতা, সামাজিক পশ্চাদপদতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রসরতা প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত। সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বের মাঝে ঐক্য ও সংহতির অভাব আজ সুস্পষ্ট। ফলে তারা জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ হতে পুরোপুরি ফায়দা উঠাতে পারছে না। এমতাবস্থায় উপরোক্ত দুর্বলতাসমূহ কাটিয়ে উঠে মুসলিম উম্মাহ যদি কেবল মহান আল্লাহ প্রদত্ত এবং মহানবী (সা.) প্রদর্শিত শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে এবং মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনার জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্রের মডেলে মানবাধিকারের শিক্ষা ও নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগে গ্রহণ করে তা হলে বিশ্ববাসীকে মানবাধিকারের গ্যারান্টি দিতে সক্ষম হবে। সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার এই উদারণ রাসূল (সা.) এর জীবনের শুরু থেকেই আজীবন নানাভাবে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন তিনি গোটা আরব জাহানের নেতা হয়ে উঠলেন তখন তিনি কি সমাজজীবনে, কি পারিবারিক জীবনে, কি রাষ্ট্রীয় তথা নাগরিক জীবনে, কি বিশ্ব নাগরিক হিসাবে- সর্বক্ষেত্রে মানুষের মূল্য-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের যে সর্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল, অভূতপূর্ব। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি-দর্শনের কয়েকটি দিকের উপর আলোকপাত করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।